The Rising Campus
Education, Scholarship, Job, Campus and Youth
শুক্রবার, ২৯শে মার্চ, ২০২৪

শাবিতে ছাত্র আন্দোলনে স্বার্থের নানা হিসাব

সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান সংকট সমাধানের দিকে গেলেও আন্দোলনের শুরু আর শেষ নিয়ে চলছে হিসাব-নিকাশ। একটি হলের প্রভোস্টের পদত্যাগের দাবি কিভাবে উপাচার্য পদত্যাগে গিয়ে ঠেকল সেই প্রশ্নই অনেকের সামনে।

সরকারদলীয় শিক্ষকদের দুটি গ্রুপ এ আন্দোলনে পেছন থেকে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

তবে শিক্ষকদের একটি পক্ষ মনে করছেন, উপাচার্য যোগদানের পরই একটি পক্ষকে বেশি সুবিধা দেওয়া, পছন্দের ব্যক্তির ওপর বেশি ভরসা করা, আর সেই সব ব্যক্তির স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবহারের কারণে শিক্ষার্থী, ছাত্রলীগ আর শিক্ষকদের মধ্যে জমা হওয়া ক্ষোভই এই আন্দোলনে ঘি ঢেলেছে। যদিও উপাচার্যের খুব ঘনিষ্ঠ কয়েকজন শিক্ষক এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

আর এসব নিয়ে এ মুহূর্তে মুখ খুলতে রাজি হননি উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। আন্দোলনের শুরু থেকে অনশন ভাঙানো পর্যন্ত নানা বিষয় নিয়ে যুগান্তরের অনুসন্ধানে বেশকিছু বিষয় উঠে এসেছে।

জানা যায়, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের সিন্ডিকেট নির্বাচন ইস্যুতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষকদের মধ্যে ভাঙন ধরে। সেই নির্বাচনে জামায়াত-বিএনপির প্রার্থীর কাছে এ গ্রুপের এক শিক্ষকের পরাজয়ের কারণ হিসাবে ষড়যন্ত্রের কুশীলব হিসাবে প্রফেসর আক্তারুল ইসলাম, রাশেদ তালুকদার, জহির উদ্দিন ও হাসান জাকিরুলকে বহিষ্কার করা হয়।

এরপর থেকে এই চার শিক্ষক পরের সব নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষকদের প্যানেলের বিপক্ষে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তচিন্তায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষকরা নামে একটি গ্রুপও তৈরি করেন। যা আওয়ামী শিক্ষক রাজনীতির বিদ্রোহী গ্রুপ হিসাবে পরিচিত। এ গ্রুপটির উত্থান হয় ২০১৪ সালে সাবেক উপাচার্য আমিনুল হক ভূঁইয়ার হাত ধরে।

২০১৪ সালে ভিসি হিসাবে নিয়োগ পান প্রফেসর আমিনুল হক ভূঁইয়া। তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষকদের সব শিক্ষক প্রশাসন থেকে পদত্যাগ করলে আমিনুল হক ভূঁইয়া তার পদ টিকিয়ে রাখতে বিদ্রোহী গ্রুপের শিক্ষকদের প্রশাসনিক পদে নিয়োগ দেন।

রাশেদ তালুকদার ছাত্রকল্যাণ উপদেষ্টা, জহির উদ্দিন প্রক্টর, হাসান জাকিরুল, শাহেদ হাসান, শরদিন্দু ভট্টাচার্য, আমিনা পারভিন, শরিফা ইয়াসমিনকে বিভিন্ন হলের প্রভোস্ট, আক্তারুল ইসলামকে সেন্টার অব এক্সেলেন্সের পরিচালক, জাকির হোসেনক গবেষণা কেন্দ্রে পরিচালক, জহির বিন আলমকে পরিবহণ প্রশাসক, হিমাদ্রী শেখরকে ভাষা ইনস্টিটিউটের পরিচালকসহ বিভিন্ন পদ বিদ্রোহী গ্রুপের শিক্ষকরা পেয়ে যান।

আর অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন ২০১৭ সালে উপাচার্য হিসাবে যোগদানে বিদ্রোহী গ্রুপটির অনেকেই তার আস্থাভাজন হয়ে যান। যদিও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষকদের প্যানেল থেকেও অনেকজনকে তিনি কাছে টেনে নেন। এর কারণ হলো তারা উপাচার্যের এলাকার লোক।

এদিকে উপাচার্যের কাছে বিদ্রোহী গ্রুপটি গুরুত্বপূর্ণ হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট, শিক্ষক সমিতি ও একাডেমিক কাউন্সিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ থেকে যান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষক প্যানেলের শিক্ষকরা। কিন্তু প্রশাসনিক পদ-পদবিতে খুব একটা সুবিধা পায়নি এ প্যানেলটি। উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন বিদ্রোহী গ্রুপের শিক্ষকদের বসিয়ে রাখেন মাঠ প্রশাসনে।

বিদ্রোহী প্যানেলের নীতিনির্ধারকদের অন্যতম জহির উদ্দিনকে প্রক্টর থেকে ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনার পরিচালক বানান তিনি। প্রক্টর হিসাবে একই প্যানেলের ড. আলমগীর কবিরকে দায়িত্ব দেন। প্রক্টরিয়াল বডিতে সাস্টিয়ানদের বাদ দিয়ে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা শিক্ষকদের যুক্ত করেন উপাচার্য। এ নিয়ে একদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষক প্যানেল ও সাস্টিয়ান শিক্ষকদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়।

কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উপাচার্যের ওপর যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে তার জন্য দায়ী ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনার পরিচালক জহির উদ্দিন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি প্রক্টর থাকাকালীন নানা ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনকে। বন্ধ করেছিলেন রোড পেইন্টিং, দেশের কোনো ঘটনায় প্রতিবাদ, মানববন্ধন করতে হলেও অনুমতিতে বাধ্যতামূলক করে দেন তিনি। সেই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের অভিযোগও রয়েছে।

একাধিক ছাত্রলীগ নেতাকর্মী অভিযোগ করেন-জহির উদ্দিন ছাত্রলীগকে নিজের স্বার্থে ব্যবহারের চেষ্টা করেছেন সব সময়। তিনি ঠিক করতে চাইতেন কোন গ্রুপ এখানে রাজনীতি করবে; কোন গ্রুপ কোণঠাসা হয়ে যাবে। তাদের ধারণা উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগকে কোণঠাসা করতেই জহির উদ্দিনকে দিয়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছেন।

এসব ক্ষোভ থেকেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের এক দফা দাবিতে মৌন সম্মতি ছিল তাদের। শুধু সম্মতি নয়, অংশগ্রহণও ছিল। এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে জহির উদ্দিনের সঙ্গে কয়েকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।

এদিকে ১৩ জানুয়ারি শুরু হওয়া হল প্রভোস্টের পদত্যাগ আন্দোলন নিয়ে অনুসন্ধান করে জানা যায়, শুরুতে এই আন্দোলন ছিল সাধারণ শিক্ষার্থীদের হাতে। উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন তাদের সঙ্গে কথা বলে আশ্বস্তও করেছিলেন। কিন্তু তাতেও আন্দোলন থামেনি।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষকদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ হলের প্রভোস্ট হওয়ার কারণে সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন এ প্যানেলের সদস্য প্রভোস্ট জাফরিন লিজা। ২ ফেব্রুয়ারি সিন্ডিকেট নির্বাচন, শিক্ষার্থীরা যেহেতু প্রভোস্টের পদত্যাগ নিয়ে আন্দোলন করছিলেন সেক্ষেত্রে জাফরিন লিজার বিরুদ্ধে আন্দোলনকে কোনো একটি গ্রুপ উসকে দিতে চেয়েছে। কারণ জাফরিন লিজা পদ হারালে অন্য গ্রুপটির লাভ হবে।

এ বিষয়ে বিদ্রোহী গ্রুপটির সিনিয়র অনেকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে কাউকে পাওয়া যায়নি। তবে গ্রুপটির অন্যতম সদস্য প্রক্টর ড. আলমগীর কবির বলেন, এখান থেকে আমাদের কোনো সুবিধা পাওয়ার ছিল না। কারণ এ হলের প্রভোস্ট পদটি উপাচার্য মহোদয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষক বলয়ের জন্য দিয়েছেন।

১৬ জানুয়ারির ঘটনার পরই জাফরিন লিজা পদত্যাগের পর তার গ্রুপ থেকেই অধ্যাপক নাজিয়াকে সেই হলের প্রভোস্ট করা হয়েছে। সুতরাং আন্দোলন থেকে কিহু আশা করার ছিল না আমাদের গ্রুপের।

যে কারণে উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে রূপ নিল : সাধারণ শিক্ষার্থীদের ছোট একটি আন্দোলন কিভাবে বড় হলো তা নিয়ে নানা বিশ্লেষণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন জানান, ১৬ জানুয়ারি উপাচার্য হেঁটেই নিজ কার্যালয়ে এসেছিলেন।

সে সময়ও হল সমস্যা সমাধানের দাবিতে আন্দোলন করছিলেন শিক্ষার্থীরা। দুপুরে শিক্ষার্থীরা নিজেদের দাবির সপক্ষে মিছিল নিয়ে গোলচত্বর ঘুরে প্রায় ১৫০ মিটার দূরের চেতনা একাত্তরের দিকে যান। সে সময় উপাচার্য বের হয়ে বাসায় যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু উপাচার্যের চারপাশে থাকা কয়েকজন তাকে বের হতে দেননি। মিছিলটি যখন আবারও গোলচত্বর প্রদক্ষিণ করে তখনই উপাচার্যকে বের করে মিছিলের মুখোমুখি করা হয়।

শিক্ষার্থীরা যখন উপাচার্যের দিকে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি না করিয়ে তাকে নিয়ে আইআইসিটি ভবনের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। সে সময় পেছন থেকে দৌড়ে যান শিক্ষার্থীরা। উপাচার্য আইআইসিটি ভবনে ঢুকলে তালা দিয়ে দেন শিক্ষার্থীরা। একটি সূত্র বলছে, এ সময় উপাচার্যকে ভয় দেখানো হয়েছে যে শিক্ষার্থীরা তার ওপর হামলা করবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষক বলেন, উপাচার্যকে যারা ভয় দেখিয়েছেন তারা মূলত উপাচার্যকে একটি বিপদের মুখোমুখি করার জন্য তাকে নিয়ে দৌড় দিয়েছিলেন। উপাচার্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বললেই বিষয়টির একটি সুরাহা হতো। শিক্ষার্থীরা যদি তাকে অবরুদ্ধ করতেই চাইত তাহলে তো উপাচার্য যখন কার্যালয়ে ছিলেন তখনই করতে পারত।

দাবি মেনে নেওয়ার পরও কেন পুলিশি হামলা : ১৬ জানুয়ারি সোয়া ৫টার দিকে যখন দাবি মেনে নেওয়া হয়। কোষাধ্যক্ষ এবং আরও কয়েকজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কাছে এ বার্তা নিয়ে গিয়েছিলেন। কোষাধ্যক্ষকে বিষয়টির লিখিত কপি আনতে উপাচার্যের কাছে যেতে দিতে তারা যখন তালা খুলছিলেন ঠিক সে সময় কেন পুলিশ হামলা চালাল? কার নির্দেশে এবং কেন হামলা? যদিও এ বিষয় নিয়ে তদন্ত কমিটি হয়েছে।

হামলা নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। কেউ বলছেন, বিষয়টি শেষ হলে হিরো হয়ে যেতেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষকদের প্যানেলের শিক্ষক কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল ইসলাম। সেই কারণেই বিদ্রোহীদের কেউ পুলিশকে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার নির্দেশ দিয়েছেন। তারা হয়তো চাননি বিষয়টি এত দ্রুত শেষ হয়ে যাক।

এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষক পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যাপক মাস্তাবুর রহমান জানান, বিষয়টি তাদের কানেও এসেছে। কিন্তু যেহেতু তদন্ত কমিটি হয়েছে তাই এ বিষয় নিয়ে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তিনি বলেন, মাঠে যারা দায়িত্বে ছিলেন শুরু থেকেই তারা জোরালো দায়িত্ব পালন করলে হয়তো এমন পরিস্থিতি তৈরি হতো না। তিনি আশা করেন তদন্ত কমিটি এ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখবে।

এ আন্দোলনে তাদের কোনো ইন্ধন ছিল কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আন্দোলনের শুরুটাই ছিল আমাদের বিরুদ্ধে। তাই এখানে ইন্ধন দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তদন্ত কমিটি পুরো বিষয়গুলো তদন্ত করবে। তদন্ত প্রতিবেদন পেলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।

সার্বিক বিষয় নিয়ে উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, এসব বিষয় নিয়ে এখন কিছু বলতে চাই না। একটু সময় যাক। সে সময় কথা বলা যাবে।

You might also like
Leave A Reply

Your email address will not be published.

  1. প্রচ্ছদ
  2. ক্যাম্পাস
  3. শাবিতে ছাত্র আন্দোলনে স্বার্থের নানা হিসাব

শাবিতে ছাত্র আন্দোলনে স্বার্থের নানা হিসাব

সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান সংকট সমাধানের দিকে গেলেও আন্দোলনের শুরু আর শেষ নিয়ে চলছে হিসাব-নিকাশ। একটি হলের প্রভোস্টের পদত্যাগের দাবি কিভাবে উপাচার্য পদত্যাগে গিয়ে ঠেকল সেই প্রশ্নই অনেকের সামনে।

সরকারদলীয় শিক্ষকদের দুটি গ্রুপ এ আন্দোলনে পেছন থেকে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

তবে শিক্ষকদের একটি পক্ষ মনে করছেন, উপাচার্য যোগদানের পরই একটি পক্ষকে বেশি সুবিধা দেওয়া, পছন্দের ব্যক্তির ওপর বেশি ভরসা করা, আর সেই সব ব্যক্তির স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবহারের কারণে শিক্ষার্থী, ছাত্রলীগ আর শিক্ষকদের মধ্যে জমা হওয়া ক্ষোভই এই আন্দোলনে ঘি ঢেলেছে। যদিও উপাচার্যের খুব ঘনিষ্ঠ কয়েকজন শিক্ষক এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

আর এসব নিয়ে এ মুহূর্তে মুখ খুলতে রাজি হননি উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। আন্দোলনের শুরু থেকে অনশন ভাঙানো পর্যন্ত নানা বিষয় নিয়ে যুগান্তরের অনুসন্ধানে বেশকিছু বিষয় উঠে এসেছে।

জানা যায়, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের সিন্ডিকেট নির্বাচন ইস্যুতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষকদের মধ্যে ভাঙন ধরে। সেই নির্বাচনে জামায়াত-বিএনপির প্রার্থীর কাছে এ গ্রুপের এক শিক্ষকের পরাজয়ের কারণ হিসাবে ষড়যন্ত্রের কুশীলব হিসাবে প্রফেসর আক্তারুল ইসলাম, রাশেদ তালুকদার, জহির উদ্দিন ও হাসান জাকিরুলকে বহিষ্কার করা হয়।

এরপর থেকে এই চার শিক্ষক পরের সব নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষকদের প্যানেলের বিপক্ষে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তচিন্তায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষকরা নামে একটি গ্রুপও তৈরি করেন। যা আওয়ামী শিক্ষক রাজনীতির বিদ্রোহী গ্রুপ হিসাবে পরিচিত। এ গ্রুপটির উত্থান হয় ২০১৪ সালে সাবেক উপাচার্য আমিনুল হক ভূঁইয়ার হাত ধরে।

২০১৪ সালে ভিসি হিসাবে নিয়োগ পান প্রফেসর আমিনুল হক ভূঁইয়া। তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষকদের সব শিক্ষক প্রশাসন থেকে পদত্যাগ করলে আমিনুল হক ভূঁইয়া তার পদ টিকিয়ে রাখতে বিদ্রোহী গ্রুপের শিক্ষকদের প্রশাসনিক পদে নিয়োগ দেন।

রাশেদ তালুকদার ছাত্রকল্যাণ উপদেষ্টা, জহির উদ্দিন প্রক্টর, হাসান জাকিরুল, শাহেদ হাসান, শরদিন্দু ভট্টাচার্য, আমিনা পারভিন, শরিফা ইয়াসমিনকে বিভিন্ন হলের প্রভোস্ট, আক্তারুল ইসলামকে সেন্টার অব এক্সেলেন্সের পরিচালক, জাকির হোসেনক গবেষণা কেন্দ্রে পরিচালক, জহির বিন আলমকে পরিবহণ প্রশাসক, হিমাদ্রী শেখরকে ভাষা ইনস্টিটিউটের পরিচালকসহ বিভিন্ন পদ বিদ্রোহী গ্রুপের শিক্ষকরা পেয়ে যান।

আর অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন ২০১৭ সালে উপাচার্য হিসাবে যোগদানে বিদ্রোহী গ্রুপটির অনেকেই তার আস্থাভাজন হয়ে যান। যদিও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষকদের প্যানেল থেকেও অনেকজনকে তিনি কাছে টেনে নেন। এর কারণ হলো তারা উপাচার্যের এলাকার লোক।

এদিকে উপাচার্যের কাছে বিদ্রোহী গ্রুপটি গুরুত্বপূর্ণ হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট, শিক্ষক সমিতি ও একাডেমিক কাউন্সিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ থেকে যান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষক প্যানেলের শিক্ষকরা। কিন্তু প্রশাসনিক পদ-পদবিতে খুব একটা সুবিধা পায়নি এ প্যানেলটি। উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন বিদ্রোহী গ্রুপের শিক্ষকদের বসিয়ে রাখেন মাঠ প্রশাসনে।

বিদ্রোহী প্যানেলের নীতিনির্ধারকদের অন্যতম জহির উদ্দিনকে প্রক্টর থেকে ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনার পরিচালক বানান তিনি। প্রক্টর হিসাবে একই প্যানেলের ড. আলমগীর কবিরকে দায়িত্ব দেন। প্রক্টরিয়াল বডিতে সাস্টিয়ানদের বাদ দিয়ে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা শিক্ষকদের যুক্ত করেন উপাচার্য। এ নিয়ে একদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষক প্যানেল ও সাস্টিয়ান শিক্ষকদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়।

কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উপাচার্যের ওপর যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে তার জন্য দায়ী ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনার পরিচালক জহির উদ্দিন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি প্রক্টর থাকাকালীন নানা ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনকে। বন্ধ করেছিলেন রোড পেইন্টিং, দেশের কোনো ঘটনায় প্রতিবাদ, মানববন্ধন করতে হলেও অনুমতিতে বাধ্যতামূলক করে দেন তিনি। সেই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের অভিযোগও রয়েছে।

একাধিক ছাত্রলীগ নেতাকর্মী অভিযোগ করেন-জহির উদ্দিন ছাত্রলীগকে নিজের স্বার্থে ব্যবহারের চেষ্টা করেছেন সব সময়। তিনি ঠিক করতে চাইতেন কোন গ্রুপ এখানে রাজনীতি করবে; কোন গ্রুপ কোণঠাসা হয়ে যাবে। তাদের ধারণা উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগকে কোণঠাসা করতেই জহির উদ্দিনকে দিয়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছেন।

এসব ক্ষোভ থেকেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের এক দফা দাবিতে মৌন সম্মতি ছিল তাদের। শুধু সম্মতি নয়, অংশগ্রহণও ছিল। এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে জহির উদ্দিনের সঙ্গে কয়েকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।

এদিকে ১৩ জানুয়ারি শুরু হওয়া হল প্রভোস্টের পদত্যাগ আন্দোলন নিয়ে অনুসন্ধান করে জানা যায়, শুরুতে এই আন্দোলন ছিল সাধারণ শিক্ষার্থীদের হাতে। উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন তাদের সঙ্গে কথা বলে আশ্বস্তও করেছিলেন। কিন্তু তাতেও আন্দোলন থামেনি।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষকদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ হলের প্রভোস্ট হওয়ার কারণে সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন এ প্যানেলের সদস্য প্রভোস্ট জাফরিন লিজা। ২ ফেব্রুয়ারি সিন্ডিকেট নির্বাচন, শিক্ষার্থীরা যেহেতু প্রভোস্টের পদত্যাগ নিয়ে আন্দোলন করছিলেন সেক্ষেত্রে জাফরিন লিজার বিরুদ্ধে আন্দোলনকে কোনো একটি গ্রুপ উসকে দিতে চেয়েছে। কারণ জাফরিন লিজা পদ হারালে অন্য গ্রুপটির লাভ হবে।

এ বিষয়ে বিদ্রোহী গ্রুপটির সিনিয়র অনেকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে কাউকে পাওয়া যায়নি। তবে গ্রুপটির অন্যতম সদস্য প্রক্টর ড. আলমগীর কবির বলেন, এখান থেকে আমাদের কোনো সুবিধা পাওয়ার ছিল না। কারণ এ হলের প্রভোস্ট পদটি উপাচার্য মহোদয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষক বলয়ের জন্য দিয়েছেন।

১৬ জানুয়ারির ঘটনার পরই জাফরিন লিজা পদত্যাগের পর তার গ্রুপ থেকেই অধ্যাপক নাজিয়াকে সেই হলের প্রভোস্ট করা হয়েছে। সুতরাং আন্দোলন থেকে কিহু আশা করার ছিল না আমাদের গ্রুপের।

যে কারণে উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে রূপ নিল : সাধারণ শিক্ষার্থীদের ছোট একটি আন্দোলন কিভাবে বড় হলো তা নিয়ে নানা বিশ্লেষণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন জানান, ১৬ জানুয়ারি উপাচার্য হেঁটেই নিজ কার্যালয়ে এসেছিলেন।

সে সময়ও হল সমস্যা সমাধানের দাবিতে আন্দোলন করছিলেন শিক্ষার্থীরা। দুপুরে শিক্ষার্থীরা নিজেদের দাবির সপক্ষে মিছিল নিয়ে গোলচত্বর ঘুরে প্রায় ১৫০ মিটার দূরের চেতনা একাত্তরের দিকে যান। সে সময় উপাচার্য বের হয়ে বাসায় যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু উপাচার্যের চারপাশে থাকা কয়েকজন তাকে বের হতে দেননি। মিছিলটি যখন আবারও গোলচত্বর প্রদক্ষিণ করে তখনই উপাচার্যকে বের করে মিছিলের মুখোমুখি করা হয়।

শিক্ষার্থীরা যখন উপাচার্যের দিকে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি না করিয়ে তাকে নিয়ে আইআইসিটি ভবনের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। সে সময় পেছন থেকে দৌড়ে যান শিক্ষার্থীরা। উপাচার্য আইআইসিটি ভবনে ঢুকলে তালা দিয়ে দেন শিক্ষার্থীরা। একটি সূত্র বলছে, এ সময় উপাচার্যকে ভয় দেখানো হয়েছে যে শিক্ষার্থীরা তার ওপর হামলা করবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষক বলেন, উপাচার্যকে যারা ভয় দেখিয়েছেন তারা মূলত উপাচার্যকে একটি বিপদের মুখোমুখি করার জন্য তাকে নিয়ে দৌড় দিয়েছিলেন। উপাচার্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বললেই বিষয়টির একটি সুরাহা হতো। শিক্ষার্থীরা যদি তাকে অবরুদ্ধ করতেই চাইত তাহলে তো উপাচার্য যখন কার্যালয়ে ছিলেন তখনই করতে পারত।

দাবি মেনে নেওয়ার পরও কেন পুলিশি হামলা : ১৬ জানুয়ারি সোয়া ৫টার দিকে যখন দাবি মেনে নেওয়া হয়। কোষাধ্যক্ষ এবং আরও কয়েকজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কাছে এ বার্তা নিয়ে গিয়েছিলেন। কোষাধ্যক্ষকে বিষয়টির লিখিত কপি আনতে উপাচার্যের কাছে যেতে দিতে তারা যখন তালা খুলছিলেন ঠিক সে সময় কেন পুলিশ হামলা চালাল? কার নির্দেশে এবং কেন হামলা? যদিও এ বিষয় নিয়ে তদন্ত কমিটি হয়েছে।

হামলা নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। কেউ বলছেন, বিষয়টি শেষ হলে হিরো হয়ে যেতেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষকদের প্যানেলের শিক্ষক কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল ইসলাম। সেই কারণেই বিদ্রোহীদের কেউ পুলিশকে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার নির্দেশ দিয়েছেন। তারা হয়তো চাননি বিষয়টি এত দ্রুত শেষ হয়ে যাক।

এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষক পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যাপক মাস্তাবুর রহমান জানান, বিষয়টি তাদের কানেও এসেছে। কিন্তু যেহেতু তদন্ত কমিটি হয়েছে তাই এ বিষয় নিয়ে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তিনি বলেন, মাঠে যারা দায়িত্বে ছিলেন শুরু থেকেই তারা জোরালো দায়িত্ব পালন করলে হয়তো এমন পরিস্থিতি তৈরি হতো না। তিনি আশা করেন তদন্ত কমিটি এ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখবে।

এ আন্দোলনে তাদের কোনো ইন্ধন ছিল কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আন্দোলনের শুরুটাই ছিল আমাদের বিরুদ্ধে। তাই এখানে ইন্ধন দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তদন্ত কমিটি পুরো বিষয়গুলো তদন্ত করবে। তদন্ত প্রতিবেদন পেলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।

সার্বিক বিষয় নিয়ে উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, এসব বিষয় নিয়ে এখন কিছু বলতে চাই না। একটু সময় যাক। সে সময় কথা বলা যাবে।

পাঠকের পছন্দ

মন্তব্য করুন