রাবিপ্রবি প্রতিনিধিঃ রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তুসি চাকমা পড়াশোনা করছেন টুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি এখন একজন উদ্যোক্তা। নিজ হাতের তৈরি পণ্য বিক্রি করে বেশ পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছেন তিনি। তার এই পর্যায়ে আসার পিছনের গল্পগুলো তুলে ধরেছেন রাবিপ্রবি প্রতিনিধি মোঃ আয়নুল ইসলাম।
তুসি বলেন, “আমার জন্ম রাঙ্গামাটি জেলার সদর উপজেলার বন্দুকভাঙ্গা ইউনিয়নের খারিক্ষ্যং গ্রামে। ছোটবেলা থেকেই আমার ভীষণ ঝোঁক ছিল বুনন (আলাম,চাদর,হাত পাখা) ও বিভিন্ন শৌখিন জিনিসপত্র তৈরির প্রতি। সুযোগ পেলে বসে পড়তাম শৌখিন জিনিস তৈরি করতে। ছোটবেলা থেকে মায়ের কাছ থেকেই একটু একটু করে কাজগুলো শেখা হয়েছে। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম তখন দেখলাম পরিচিত সবাই টিউশন করে তাদের খরচ নিজেরাই বহন করছে, তাই আমিও চেয়েছিলাম আত্মনির্ভরশীল হতে।”
যেভাবে শুরুঃ
২০১৮ সালে প্রথম হোল সেলারদের কাছে বিক্রি করি। তারপর ২০২০ সাল থেকে ফেইসবুকের বিভিন্ন গ্রুপের মাধ্যমে বিক্রি করা শুরু করি।
সোশ্যাল মিডিয়াতে পেইজ খোলা নিয়ে আমার তেমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না। ব্যবসা শুরু করবো কি করবো না এই নিয়ে বেশ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম। তবে আমি হুট করে একদিন বেশি কিছু না ভেবে ‘আলাম কালেকশন’ নামে একটা পেইজ খুলে নিই এবং সেখান থেকেই শুরু আমার উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প। এখন আমি অনলাইনে হাতের তৈরি বিভিন্ন জিনিস যেমন- আলাম, হাত পাখা, ইয়ক দিয়ে ফতুয়া, চাদর,হোজ্জাল (ব্যাগ) বিক্রি করে থাকি।
আলাম কালেকশন নামকরণের গল্পঃ
আলামকে বলা হয় চাকমাদের বুনন শিল্পের গ্রামার। যুগ যুগ ধরে পাহাড়ি নারীরা আলাম তৈরির মাধ্যমে ধরে রেখেছে তাদের ঐতিহ্য। চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পিনন-হাদি থেকে শুরু করে বুনন শিল্পের কাজ শিখতে হলে আলাম বুনন শিখতে হয়। তাই আলামকে বলা হয় বুনন শিল্পের গ্রামার। গ্রামার না পারলে যেমন ইংরেজি পারা যায়না,তেমনি আলাম বুনন না পারলে চাকমাদের অন্যান্য বুনন কাজগুলো পারা যায় না। বর্তমান সময় আলাম খুব কম মানুষ চিনে। কিন্তু পিনন- খাদি সবাই চিনে। বর্তমানে অনেকে আলামের উৎপত্তি জানেনা। এজন্যই এই আলামকে এখন সংরক্ষণে রাখা হচ্ছে ওয়ালম্যাট হিসেবে। আগেকার চাকমা মেয়েরা প্রায়ই বুনন করত।তখনকার সময় বলা যায় এই বুনন না পারলে বিয়ে হতো না। প্রায় সবাই নিজের পোশাক নিজে তৈরি করত।বর্তমানের মতো বানিজ্যিক চিন্তা ভাবনা ছিল না। তাই সবার ঘরে ঘরে নারীদের আলাম থাকত। বর্তমানে অধিকাংশ মেয়ে এই বুনন কাজ পারে না।কিন্তু যাদের মনে ঐতিহ্যের ঠান আছে তারা সংরক্ষণ করে রাখছে।
সব পরিকল্পনা ঠিকঠাক হওয়ার পর আমি পেইজের জন্য একটা ইউনিক নাম খুঁজছিলাম। তখন হঠাৎ মনে হলো, আমি যেহেতু আলাম বুননের কাজ জানি তাই আমাদের এই ঐতিহ্য ধরে রাখা ও সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ‘আলাম কালেকশন’ নামে পেইজটির নামকরণ করি।
হাত পাখা, চাদর, ফতুয়া ও ব্যাগ তৈরির গল্পঃ
একদিন আমার পরিচিত একজন বিভিন্ন উপদেশ দিয়ে আমাকে উৎসাহ দিচ্ছিলেন। একসময় তিনি বলে উঠলেন, “কোনো কাজ ছোট বড় নয়। তোমরা যা কিছু করতে পারো, সেই মেধাকে কাজে লাগিয়ে নতুন কিছু করতে পারো।”
এই কথা শোনার পর আমিও মনে মনে ভাবলাম, আমিও তো ভালো হাত পাখা, চাদর, ফতুয়া ও ব্যাগ বানাতে পারি, এখন একটু চেষ্টা করে দেখি। তারপর আমি বানানো শুরু করি। এখন বর্তমানে সেখান থেকে আমার ভালো আয়ও হচ্ছে।
নিজের স্বপ্ন নিয়ে তুসি বলেন, “আমি এই ব্যবসার পেছনে অনেক সময়, ধৈর্য আর পরিশ্রম ব্যয় করেছি। এখন আমি বেশ সাড়াও পাচ্ছি। অনেক ভালো লাগে যখন দেখি আমার নিজের বানানো আলাম মানুষ ক্রয় করতেছে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়াতে দিচ্ছে। তখন নিজে নিজেই খুব গর্ববোধ করি। আসলে এসব কাজ করতে অনেক সময় আর ধৈর্য প্রয়োজন হয়। আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করে এসব জিনিস তৈরি করি। দিন শেষে যখন কেউ আমার জিনিসগুলো পছন্দ করে তখন আমার নিজের কাছেই এই কষ্টগুলো সার্থক মনে হয়। আমি এখনও একজন ক্ষুদে ব্যবসায়ী। আমার ইচ্ছা একদিন আমার এই ছোট্ট পেইজটাকে অনেক বড় করে তুলবো।”
তুসি চাকমার ফেইসবুক পেইজ লিংকঃ https://shorturl.at/p2SFv