রাবি প্রতিনিধি : গভীর শোক ও শ্রদ্ধায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) জাতীয় শোক দিবস পালন করা হয়েছে। দিবসের শুরুতে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রশাসনভবনসহ অন্যান্য ভবনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত ও কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়।
মঙ্গলবার (১৫ আগস্ট) সকাল সাড়ে ৯ টায় উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার শোক র্যালিসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
এসময় উপস্থিত ছিলেন উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. সুলতান-উল-ইসলাম, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. অবদায়দুর রহমান প্রামানিক, রেজিস্ট্রার অধ্যাপক মো. আবদুস সালাম, প্রক্টর অধ্যাপক মো. আসাবুল হক, ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক মো. জাহাঙ্গীর আলম সাউদ, জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক অধ্যাপক প্রদীপ কুমার পাণ্ডে, হল প্রাধ্যক্ষ, ইনস্টিটিউট পরিচালক, বিভাগীয় সভাপতিগণসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ।
সেখানে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করে মোনাজাত করা হয়।
পরে বিভিন্ন আবাসিক হল ও বিভাগ, রাবি শিক্ষক সমিতি, ক্যাম্পাসের স্কুলসমূহ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ, রাবি বঙ্গবন্ধু পরিষদসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এবং পেশাজীবী ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে।
দিবসটি উপলক্ষে সকাল ১০টায় শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সিনেট ভবনে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. অবায়দুর রহমান প্রামানিক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. সুলতান-উল-ইসলামের সভাপতিত্বে সভায় ‘আমার দেখা নয়াচীন : বঙ্গবন্ধুর পর্যবেক্ষণ ও আমাদের শিক্ষণীয়’ শীর্ষক বক্তৃতা দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ মুজিব রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর পিস এন্ড লিবার্টি এর পরিচালক অধ্যাপক ফকরুল আলম। রেজিস্ট্রার অধ্যাপক আব্দুস সালাম আলোচনা সভাটি সঞ্চালনা করেন।
আলোচনায় অধ্যাপক ফকরুল আলম বলেন, দেশ ও জাতির জন্য বঙ্গবন্ধুর চিন্তা সম্পর্কে জানতে হলে যে বইটি আমাদের বেশি পড়া প্রয়োজন সেটি হলো তাঁর আমার দেখা নয়াচীন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে কয়টি বই লিখেছিলেন তাঁর মধ্যে আমার দেখা নয়াচীন প্রথম। আজকের জাতীয় শোক দিবসে যদি বঙ্গবন্ধুর কথা চিন্তা করি তাহলে এই বইটিই আমাদের কাছে তাঁর স্মৃতিকে উজ্জ্বল করছে। আগামীর প্রজন্মকে এই বইটি আলো হয়ে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখাতে পারে। বঙ্গবন্ধু কারাগারে থেকেই ফরাসি বিপ্লব সম্পর্কে পড়েছেন, সেই বিপ্লবে যাঁরা জীবন দিয়েছেন তাদের কথা, চিন্তা-চেতনাকে তিনি স্মরণ করছেন। তিনি ছিলেন এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, এজন্যই তিনি অসাধারণ আমাদের কাছে, সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন তিনি। বঙ্গবন্ধুকে জানতে হলে, ভালোভাবে বুঝতে হলে বঙ্গবন্ধুর লেখা পড়ার জন্য তিনি তরুণ প্রজন্মের প্রতি আহ্বান জানান।
আমার দেখা নয়াচীন প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, বইটির প্রথম ১০০ পৃষ্ঠা জুড়ে আছে তিনি কোথায় কোথায় গিয়েছেন, কী কী দেখেছেন সে সবের বর্ণনা। পরের ৩৫ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু নিজের দেশ গঠনের চিন্তা প্রকাশ পেয়েছে। বইটির শেষের দিকে আলোচনায় নতুন দেশ, নতুন মানুষ; সবখানে নতুনের একটা সুগন্ধ আছে বলে অধ্যাপক ফকরুল মন্তব্য করেন।
অনুষ্ঠানে উপাচার্য ১৫ আগস্টে শহীদ বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যবৃন্দসহ অন্যান্য শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, আগস্ট বাঙালি জাতির জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ মাস। ১৫ আগস্টে আমরা হারিয়েছি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, তেমনি হারিয়েছে বঙ্গমাতাকে। ২১ আগস্ট, ২০০৪-এ চেষ্টা করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর শেষ আলো নিভিয়ে ফেলার। আবার এই আগস্টেই জন্ম হয়েছিল বঙ্গমাতা ও বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ কামালের। বঙ্গমাতা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চিন্তার বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টি তাঁর জীবনকে আলোকিত করেছে, জাতিকে মুক্তির পথ দেখিয়েছে।
উপাচার্য আরো বলেন, বঙ্গবন্ধু নিজ কর্মগুণে হয়ে উঠেছিলেন অসাধারণ। তাই তিনি জাতির পিতা, দেশের রাষ্ট্রপতি হয়েও মধ্যবিত্তের মতোই বাস করতেন নিজ বাড়িতে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই বাড়ি থেকেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু অনেকের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন কিন্তু তেমন সাড়া পাননি।
বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতাতেই নেতৃত্ব দেননি, তিনি জাতিকে একটি সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন যা আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার উজ্জ্বল নিদর্শন। এই সংবিধানে দক্ষিণ এশিয়ায় তিনিই প্রথম ধর্মনিপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় চার আদর্শের অন্যতম হিসেবে সংযোজন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার হয়েছে, কিন্তু এর নেপথ্য কুশীলবদের বিচার এখনো হয়নি। এসব কুশীলবদের চিহ্নিত করে তাদের যথাযথ বিচারের মুখোমুখি করারও তিনি দাবী জানান।
কেন আমরা গান গাইতে পারিনা যে বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করেছি। বাঙালি কি এই অতীত রোমন্থন করতে ভালোবাসে? বর্তমানকে কী রক্ষা করতে পারেনা? তখন এমন করে কেউ বলেনি ‘একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার’। সেই সময় বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করার জন্য অনেকেরই সামর্থ্য ছিলো কিন্তু তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা হয়নি। যে চেষ্টাটা আমরা দেখেছি ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায়। এই দিন জননেত্রী শেখ হাসিনাকে মানব ঢাল দিয়ে রক্ষা করা হয়েছে। কিন্তু ৭৫ এ আমরা সেই দৃশ্যটা পাইনি, যা অত্যন্ত বেদনার।
অনুষ্ঠানের সভাপতি উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট শহীদ বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সবার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, জাতীয় শোক দিবস বাঙালি জাতির স্বজন হারানোর দিন, স্বাধীনতার স্বপক্ষের সবার শোকাবহ দিন। তিনি অধ্যাপক ফকরুল আলমকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আমার দেখা নয়াচীন : বঙ্গবন্ধুর পর্যবেক্ষণ ও আমাদের শিক্ষণীয় শীর্ষক আলোচনা করে আমাদের সকলকেই আলোকিত করেছেন। আমরা হয়তো অনেকেই বইট পড়েছি কিন্তু অনেক বিশ্লেষণের জায়গা ছিলো। তা আমরা সঠিক সময়ে বুঝে উঠতে পারিনি। অধ্যাপক ফকরুল আমাদের সামনে সহজভাবে তা উপস্থাপন করেছেন। সকলকেই সেই আলোকে আলোকিত করেছেন, একজন রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু সেই সুদূর অতীতের চীনকে দেখেছেন, চীনের সমাজকে দেখেছেন, মানুষকে দেখেছেন। রাজনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কল-কারখানা সবকিছু উনি দেখেছেন। সেই দৃষ্টিতে বাংলাদেশের মুক্তির কথা ভেবেছেন। যা কিছু ভালো, সেখান থেকে গ্রহণ করে নিজের জীবনে বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছেন বঙ্গবন্ধু। একেই বলে একজন রাষ্ট্রনায়কের সুদূরপ্রসারী চিন্তা। আর সেজন্যই তিনি রাষ্ট্রনায়ক, জাতির পিতা, বিশ্বের নিপিড়ীত মানুষের নেতা।
এই অনুষ্ঠানেই রাবি বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল ও রাবি শেখ রাসেল মডেল স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য রচনা, চিত্রাঙ্কন ও কুইজ প্রতিযোগিতার পুরস্কার প্রদান করা হয়।
দিবসটি উপলক্ষে অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে আছে, বাদ জোহর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে কোরআনখানি ও মিলাদ মাহফিল, বিকেল ৫টায় শহীদ মিনার মুক্তমঞ্চে আবৃত্তি, গান ও নাটক পরিবেশন এবং সন্ধ্যায় শহীদ মিনারে মোমবাতি প্রজ্বালন ও কেন্দ্রীয় মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনা।