দৈনিক ৬-৮ ঘণ্টা ঘুম একজন সাধারণ মানুষের সুস্বাস্থ্যের জন্য খুবই দরকারি। কিন্তু, এই ঘুম যদি হয় কোনো ব্যক্তির আতঙ্কের কারণ, তবে তা শারীরিক ও মানসিক উভয় স্বাস্থ্যের জন্যই ক্ষতিকর। বোবায় ধরলে সাধারনত ঘুমের মধ্যে অনেক সময় শরীরের ওপর ভারী কিছু বসিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অনুভূত হয়। এ সময় হাত-পা নাড়ানো যায় না।
বোবায় ধরা কী?
চিকিৎসাশাস্ত্রের ভাষায় এই সমস্যাকে বলা হয় স্লিপ প্যারালাইসিস । স্লিপ প্যারালাইসিস হলে আক্রান্ত ব্যক্তির ঘুমটা হঠাৎ ভেঙ্গে যায়, ফলে কিছু সময়ের জন্য কথা বলা বা নাড়াচাড়া করার শক্তি হারিয়ে ফেলেন। মনে হয় যে নিজের হাত পা নাড়ানোর মতো কোন শক্তি নাই, এমনকি মুখে আওয়াজ করার মতো শক্তিটাও পায়না। অনেক চেষ্টা করলে গোঙানির মতো শব্দ হয়। ওই সময়টায় রোগী ভীষণ ঘাবড়ে যান, ভয় পেয়ে যান। মনে হয় যেন এই বোধহয় দম আটকে মারা যাব।
এটি সাধারণত কয়েক সেকেন্ড থেকে এক মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। কিন্তু আক্রান্ত্র ব্যক্তির তাতেই মনে হয় ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। বোবায় ধরা বা স্লিপ প্যারালাইসিস হল গভীর ঘুম ও জাগরণের মাঝামাঝি একটি স্নায়ুজনিত সমস্যা। ঘুমের ওই পর্যায়টিকে বলা হয় র্যাপিড আই মুভমেন্ট বা সংক্ষেপে রেম। রেম হল ঘুমের এমন একটি পর্যায় যখন মস্তিষ্ক খুব সক্রিয় থাকে এবং এই পর্যায়ে মানুষ স্বপ্ন দেখে থাকে। কিন্তু সে সময় শরীরের আর কোন পেশী কোন কাজ করেনা। এ কারণে এসময় মস্তিষ্ক সচল থাকলেও শরীরকে অসাড় মনে হয়।
🍀 বোবায় ধরা কাদের হয়, কেন হয়?
বোবায় ধরা বা স্লিপ প্যারালাইসিস হওয়ার নির্দিষ্ট কোন বয়স নেই। এই পরিস্থিতি যে কারও সঙ্গে যেকোনো বয়সে হতে পারে। স্লিপ প্যারালাইসিস হওয়ার পেছনে কিছু কারণকে চিহ্নিত করেছে তারা।
১. পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব বা ছেড়ে ছেড়ে ঘুম হওয়া। অসময়ে ঘুমানো। অনেক সময় কাজের সময় নির্দিষ্ট না হলে, অথবা দূরে কোথাও ভ্রমনে গেলে এমন ঘুমের সমস্যা হতে পারে।
২. মাদকাসক্ত হলে অথবা নিয়মিত ধূমপান ও মদপান করলে।
৩. পরিবারে কারও স্লিপ প্যারালাইসিস হয়ে থাকলে।
৪. সোশ্যাল অ্যাঙ্কজাইটি বা প্যানিক ডিসঅর্ডার বা বাইপোলার ডিজঅর্ডারের মতো মানসিক সমস্যা থাকলে।
🍀বোবায় ধরার লক্ষণ:
১. বড় করে নিশ্বাস নিতে অনেক কষ্ট হয়। মনে হবে যেন বুকের মধ্যে কিছু চাপ দিয়ে আছে। দম বেরোচ্ছেনা।
২. অনেকের চোখ খুলতে এমনকি চোখ নাড়াচাড়া করতেও সমস্যা হয়।
৩. অনেকের মনে হয় যে কোন ব্যক্তি বা বস্তু তাদের আশেপাশে আছে, যারা তার বড় ধরণের ক্ষতি করতে চায়।
৪. ভীষণ ভয় হয়। শরীর ঘেমে যায়।
৫. হৃৎস্পন্দন ও শ্বাস প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যায়। অনেকের রক্তচাপও বাড়তে পারে।
৬. পুরো বিষয়টা কয়েক সেকেন্ড থেকে এক মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। প্রভাবটি কেটে গেলে আগের মতো কথা বলা বা নড়াচড়া করায় কোন সমস্যা থাকেনা। তারপরও অনেকে অস্থির বোধ করেন এবং পুনরায় ঘুমাতে যেতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।
🍀 চিকিৎসা:
স্লিপ প্যারালাইসিস আসলে গুরুতর কোনও রোগ নয়। মাঝে মাঝে নিজে থেকেই ভাল হয়ে যায়। মনকে চাপমুক্ত রাখার পাশাপাশি ঘুমানোর অভ্যাসে ও পরিবেশে ইতিবাচক পরিবর্তন আনলে অনেক ক্ষেত্রেই এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
১. রাতে অন্তত ৬ ঘণ্টা থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমানোর চেষ্টা করা এবং সেই ঘুম যেন গভীর হয়।
২. প্রতিদিন রাতে একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়া এবং সকালে একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে জেগে ওঠার অভ্যাস করা। এমনকি ছুটির দিনগুলোতেও।
৩. ঘুমের জন্য শোবার ঘরটিতে আরামদায়ক পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করতে হবে। যেন সেই ঘরে কোলাহল না থাকে, ঘরটি অন্ধকার থাকে এবং তাপমাত্রা সহনীয় মাত্রায় থাকে, খুব বেশি না আবার কমও না।
৪. ঘুমাতে যাওয়ার আগ মুহূর্তে ভারী খাবার সেইসঙ্গে ধূমপান এবং ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় যেমন চা-কফি খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
৫. ঘুমাতে যাওয়ার অন্তত চার ঘণ্টা আগে ব্যায়াম করার চেষ্টা করা।
৬. ঘুমের সময় হাতের কাছে মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ অর্থাৎ ঘুমের বাঁধা হতে পারে এমন কোন বস্তু রাখা যাবেনা।
৭. দিনের বেলা দীর্ঘসময় ঘুম থেকে বিরত থাকতে হবে।
৮. স্লিপ প্যারালাইসিস হলে নিজের মনকে প্রবোধ দিতে হবে যে ভয়ের কিছু নেই, এই পরিস্থিতি সাময়িক, কিছুক্ষণ পর এমনই সব ঠিক হয়ে যাবে। এই সময়ে শরীর নাড়াচাড়া করার চেষ্টা থেকে বিরত থাকতে হবে।
কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে: এসব নিয়ম মেনে চলার পরও যদি কারও বাড়াবাড়ি রকমের স্লিপ প্যারালাইসিস হয় অর্থাৎ আপনার ঘুমে নিয়মিতভাবে ব্যাঘাত ঘটে তাহলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
ডা. মো ফরিদ উদ্দিন, এমবিবিএস (ঢাবি), সিসিডি (BIRDEM), এম এস সি (UK), ফেলোশিপ ট্রেনিং ডায়াবেটিস – সিএমসি হাসপাতাল, চেন্নাই, ভারত।