রংপুরের মোমিনপুর চানকুটি মাছুয়াপাড়ায় আমাদের বাড়ি। ২০১৬ সাল, সবেমাত্র গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে। গ্রামের অনেক পরিবারের মতো ছোটবেলায় অভাব-অনটন ছিল আমাদের নিত্যসঙ্গী। ছোটবেলায় একরকম বাবার কথা না শুনেই পড়াশোনা চালিয়ে গেছি। ষষ্ঠ শ্রেণি পাস করে যখন সপ্তম শ্রেণিতে উঠলাম, বাবা বেঁকে বসলেন; আর পড়াতে পারবেন না। বাড়ির অন্যরাও চাচ্ছিলেন, আমি যেন আয়রোজগার শুরু করি।
চার ভাইয়ের মধ্যে আমি তৃতীয়। আমার বড় ভাই হাফেজি পড়েছেন। মেজ ভাই বেশি দূর পড়াশোনা করতে পারেননি, বর্তমানে শ্রমিকের কাজ করেন। আমার ছোট ভাই আমার চেয়ে বছরখানেকের ছোট, টাকার অভাবে তারও পড়াশোনা হয়নি। তিনি ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে শ্রমিকের কাজ করেন।
আমার বাবা তখন অন্যের জমিতে কাজ করতেন। আকালের সময় দুমুঠো ভাতের জন্য বাবা একদিন আমাকে রংপুর শহরের একজনের বাড়িতে রেখে এলেন। সেখানে তিন বেলা খাবার আর থাকার বিনিময়ে বাড়ির ফুট–ফরমাশ খাটতে হবে। সেই সঙ্গে ওই বাড়ির শিশুর সঙ্গে খেলাধুলা করা। খেলাধুলা করতে আমার ভালোই লাগত। কিন্তু বাড়ির ছোটরা যখন পড়তে বসত, আমার মন খারাপ হতো। মনে হতো, আমিও যদি এভাবে পড়তে পারতাম। ওই বাড়িতে যাওয়ার আগে শুনেছিলাম, কাজের ফাঁকে আমাকে পড়াশোনার সুযোগ দেওয়া হবে। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর ওই বাড়ির কর্তা বলে দিলেন, ‘তুমি তো কাজ করতে এসেছ। পড়াশোনা করা যাবে না।’
তাঁর মুখে কথাটা শোনার পর আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। কান্না পেল। ওই রাতেই ঠিক করলাম, এখানে আর থাকব না। পরদিন সকাল হতেই গ্রামে ফেরার পথ ধরলাম। রংপুর শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার পথ। সকালে রওনা দিয়ে পায়ে হেঁটে বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেল।
বাড়ি ফিরে আসায় বাবা ভীষণ রেগে গেলেন। গায়ে হাতও তুললেন। আসলে ক্ষুধার কষ্টের কাছে পড়াশোনা বিলাসিতা। দিনকয়েক বাড়িতে থাকার পর বাবার রাগ পড়ে গেল। বাবাকে বোঝালাম, আমার পড়াশোনার খরচ আমিই চালাব। তবু আমি পড়তে চাই।
এরপর গ্রামের এক ধনাঢ্য বাড়িতে গিয়ে ‘লজিং মাস্টার’ হিসেবে থাকা শুরু করলাম। বাড়ির দুই মেয়েকে পড়াই আর হাটবাজার, গরু–ছাগল দেখাশোনা করি। প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠেই গরুর জন্য ঘাস কাটতে বেরিয়ে পড়ি। গরুর পরিচর্যা শেষে খাওয়াদাওয়া। তারপর মাদ্রাসা। সন্ধ্যায় গরু গোয়ালঘরে রেখে ওই বাড়ির দুই মেয়েকে পড়ানো। তাদের পড়ানোর সময় আমার পড়াটাও শেষ করতাম।
দাখিল পরীক্ষার আগপর্যন্ত এভাবেই চলল। তারপর ওই বাড়িতে থাকা ছেড়ে দিলাম। ২০০৮ সাল। দাখিল পরীক্ষায় মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ–৪.৮১ পেলাম। আমাদের গ্রামে কখনো এত ভালো ফল কেউ করেনি। তখন আমাদের গ্রামের গণিতের এক শিক্ষক পরামর্শ দিলেন রংপুর শহরে ভর্তি হতে। ধাপসাতপাড়া বায়তুল মোকারম মডেল কামিল মাদ্রাসায় ভর্তি হলাম। কয়েক মাসের মধ্যেই রংপুর শহরে টিউশনি খুঁজে নিলাম।
রংপুরেও কিছুদিন লজিংও ছিলাম। একটা বাড়িতে থাকতাম। ওই বাড়ির তিন পরিবারের তিন ছেলেমেয়েকে পড়াতাম। তিন বেলা তিন পরিবারে খাওয়াদাওয়া করতাম। অবশ্য মাসখানেক ওই বাড়িতে থাকার পরই মেসে উঠেছিলাম।
আলিম পরীক্ষায় আমার ফল আরও ভালো হলো। জিপিএ–৫ পেলাম। এরপর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে ভর্তি হলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগ পর্যন্ত বিসিএসের ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা ছিল না। তবে স্বপ্ন ছিল, ব্যাংক বা সরকারি কোনো চাকরি করব।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কিছুদিন পরই পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ দেখে আমার বিভাগের গোলাম রব্বানী স্যার বলেছিলেন, ‘এই ব্যাচ থেকে যদি একজনেরও বিসিএস ক্যাডার হওয়ার যোগ্যতা থাকে, তাহলে সেই একজন হলো তুমি।’ স্যারের ওই কথায় ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত হই। এর পর থেকে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিলাম। একবারেই সফল হয়েছি, এমন না। ৩৭ ও ৩৮তম বিসিএসে হোঁচট খেয়েছি। তবে ৪০তম বিসিএসে এসে আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। এদিকে আমি ৪১তম বিসিএসের মৌখিক পর্যন্ত পৌঁছে গেছি।
আমি বিশ্বাস করি, ধৈর্য নিয়ে পরিশ্রম করলে সাফল্য ধরা দেবেই। এসব অভিজ্ঞতার কথা অন্যদের বলতে আমি কখনো সংকোচ বোধ করি না। বরং আমার সংগ্রামের ঘটনাগুলোই আমাকে আগামী দিনের জন্য শক্তি জোগায়। সূত্র: প্রথম আলো