The Rising Campus
Education, Scholarship, Job, Campus and Youth
শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪

যৌন হয়রানির পেছনে দায়ী কে?

আহসান কবির, ঢাবিঃ যৌন হয়রানি আমাদের সমাজে এক প্রচলিত সমস্যা। প্রতিদিনের সংবাদপত্রের কিছু পরিচিত শিরোনাম থাকে। তারমধ্য যৌন হয়রানি নিয়ে শিরোনাম থাকাটা যেন আবশ্যক হয়ে গেছে।

যৌন সংক্রান্ত অবাঞ্চিত আবদারই যৌন হয়রানি। অনেকে হয়তো জানেনা যৌন হয়রানকারি অথবা ভুক্তভোগী যে কোন লিঙ্গের হতে পারে। আমরা যৌন হয়রানি শব্দটি মূলত স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ হিসেবে ব্যবহার করে থাকি। যেমন প্রোপাগান্ডা শব্দটির অর্থ হলো প্রচার কিন্তু আমরা এটাকে অপপ্রচার অর্থে ব্যবহার করি। অর্থাৎ শব্দটিকে নারীবাচক করে ফেলেছি। যৌন হয়রানি শব্দটি উচ্চারিত হলেই মস্তিষ্কে নারী কল্পনা ফুটে ওঠে। এর পেছনে মূলত কারণ আমাদের পুরুষ নিয়ন্ত্রিত সমাজ বা পুরুষতান্ত্রিকতা।

যৌন হয়রানির শিকার হয়নি এমন মেয়ে পৃথিবীতে আছে কিনা জানা নেই। কেউ প্রকাশ করে, কেউ প্রকাশ করেনা। আবার অনেকেই বুঝেনা সে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে কিনা। আমরা সহজ-সরল বাঙালি গ্রাম্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শালী-দুলাভাই বিয়াই বিয়াইন একে অপরকে কটুক্তি করবেন গায়ে হাত দিবে এগুলো যেন প্রথা।

সাজিদা ফাউন্ডেশন এর মতে, পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার এবং ৭ শতাংশনারী জীবনের কোনো না কোনো এক সময় ধর্ষণের শিকার হয়। বাংলাদেশ ৮৪ শতাংশ নারী নিয়মিত রাস্তাঘাট, যানবাহন, মার্কেট এমনকি বাড়িতেও যৌন হয়রানির শিকার হয়। বাসে যাত্রী,বাসের হেল্পার ড্রাইভার দ্বারা ৪১ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে।

এইতো গত বছর ২৫ শে আগস্ট বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে জাকিয়া সুলতানা রুপা চলন্ত বাসে ধর্ষণের শিকার হয় এবং পরবর্তীতে তাকে হত্যা করা হয়। একই বছর ১০ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংয়ের ভালুকায় ১৩ বছরের এক কিশোরী বাসে আবার যৌন হয়রানির শিকার হয়। এবছর ৪ আগস্ট কুষ্টিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জগামী ঈগল এক্সপ্রেসের চলন্ত বাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ডাকাতির পাশাপাশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বলে যাত্রীদের বয়ানে তথ্য উঠে এসেছে। গত ১৭ জুলাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজ সহপাঠী কর্তৃক যৌন হয়রানির শিকার হয়, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী।

এখন প্রশ্ন হলো যেহেতু এটি একটি মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি এবং এর বিপরীতে আইনের ব্যবস্থাও আছে। তারপরও কেন? কেন বর্তমানে আরও মারাত্মক রূপ ধারণ করছে? এর মূল সমস্যাটা কোথায়? হয়তো অনেকেই বলবেন কঠোর শাস্তির অভাব। তবে যারা অপরাধ করছে। তাদেরকে শাস্তি দিয়েই যদি কোনো ফলাফল পাওয়া যেত তবে এতদিনে আমাদের সমাজ থেকে যৌন হয়রানির মতন অন্যান্য অপরাধপ্রবণতা হয়তো কমে যেত।

শাস্তি সমাজের থেকে অপরাধ দূর করতে পারেনা। শাস্তি কে বলা যেতে পারে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমিক ধাপ। আইন আদালতের মাধ্যমে হয়তো কোনো অপরাধ প্রবণতাকে কিছুদিনের জন্য দমিয়ে রাখা যেতে পারে কিন্তু কিছুদিন পরে আবারো একই অবস্থা দেখা যায়।

এটা প্রমাণিত যে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের দ্বিতীয় মাধ্যম বা আইন আদালতের মাধ্যমে অপরাধ প্রবণতা বন্ধ করা যায় না। যৌন হয়রানির মতো সকল অপরাধকে দূর করতে সমাজের মূলে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন আমাদের সমাজ ও সামাজিকরণ পদ্ধতিতে। যেহেতু এটি একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য মানুষ যেটা দেখে বা শেখে সেটা বাস্তবে প্রয়োগ করার চেষ্টা করে। সামাজিকীকরণের প্রধান মাধ্যম হলো পরিবার। পরিবার অবচেতনভাবেই একটি শিশুকে শেখায় নারীকে অবমাননা করতে হবে, সংকীর্ণ করতে হবে এবং সব সময় তাদেরকে অবদমন করে রাখতে হবে।

২০ বছরের একটা মেয়ে যখন বাইরে বের হয় তখন তার সুরক্ষা প্রদান করার জন্য চতুর্থ শ্রেণীতে পড়া তার ভাইকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এটা দ্বারা প্রমাণ করছি ২০ বছর বয়সী মেয়েটিও চতুর্থ শ্রেণীতে পড়া ছেলেটির থেকেও দুর্বল। ফলে আমরা সামাজিকীকরণের মাধ্যমে একটি শিশুকে অবচেতনভাবে এইটুকু জানিয়ে ফেলছি যে নারীরা আমাদের সমাজে অরক্ষিত এবং দুর্বল।

পাশাপাশি একটা শিশু তার জন্মের পর থেকেই বেড়ে ওঠা পর্যন্ত পরিবারের ভিতর দেখে আসে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, বিচার-সালিশ ইত্যাদিতে পুরুষ সদস্যদের প্রভাব। নারী সদস্যদের অবস্থান সেখানে নেই বললেই চলে। একটা শিশু যখন এই পরিস্থিতি দেখে তখন অবচেতনভাবেই তার মস্তিষ্কে গৃহীত হয়ে যায় নারীরা মতামত প্রকাশের কেউ না।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রামীন পরিবারে অকথ্য ভাষায় গালাগালি বা মারধর ঘটলে পুরুষ যদি দোষীও হয় দোষটা গিয়ে পড়ে নারীর উপর। মেয়ের বাড়ির লোকজন এসেও মেয়েকে দোষারোপ করবে। শেষ-মেষ পুরুষের মেল ইগোকে কদর করে, অনেক কাকুতি-মিনতি করে মেয়ের বাবার বাড়ির লোকজন মিলিয়ে দিয়ে যাবে। এই বিষয়ে যখন একটা সন্তান দেখছে তখন সেও মনে মনে এই মেল ইগো লালন করে এবং ভবিষ্যৎ জীবনে প্রয়োগ করার জন্য উৎসাহিত হয়।

বর্তমান সময়ে সামাজিকরনের সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী মাধ্যম হল মিডিয়া।নগরায়নের ফলে পরিবারগুলো যৌথ পরিবার থেকে ভেঙে গিয়ে অনু পরিবারে পরিণত হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাবা-মা দুজনই কর্মজীবী হওয়ায়, শিশুরা টেলিভিশন ও মোবাইল ফোনের মত ডিভাইসের সাথে বেশি সময় কাটাচ্ছে। বর্তমানে সকল সিনেমা বা অন্যান্য টেলিভিশন প্রোগ্রাম ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে তৈরি হচ্ছে। পারিবারিক শো পাওয়া খুবই দুষ্কর। সে ক্ষেত্রে ভাষা আচার-আচরণ এবং সিনেমায় হিরো হিরোইনদের উপস্থাপন বিশেষ করে নারী অভিনেত্রীদের কে আবেদনময়ী উপস্থাপন।পাশাপাশি নারী অভিনেত্রীকে ইফটিজিং, ওর্না ধরে টান , বিভিন্ন ধরনের লাইন এমনকি ধর্ষণের মতন ঘটনা তো থাকবেই। শিশু যখন এই জিনিসগুলো দেখে এবং সামাজিকীকরণের অংশ হিসেবে তারা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করবে এটাই স্বাভাবিক।।

মিডিয়া আমাদেরকে অবচেতনভাবে বিভিন্ন অশোভন আচরণের দিকে উস্কে দেয়। একটা বাস্তব অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেই বুঝতে অনেক সহজ হবে। গত কয়েকদিন ধরেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্কুল পোশাক পরিহিত অবস্থায় একটা গান ঘুরে বেড়াতে দেখছি। “বরিশালের পেয়ারা মেয়েদের কি চেহারা, ও মামনি একটু দাঁড়াও না ছোট্ট করে আমার গালে হাম দিয়ে যাওনা”। একদিন দেখলাম স্কুলপড়ুয়া কিছু শিক্ষার্থী ফুলার রোড দিয়ে হেটে যাচ্ছে এবং স্কুল পোশাক পরিহিত ছাত্রীদের উদ্দেশ্য করে উক্ত গানটি পরিবেশন করছে।

মিডিয়া ভায়োলেন্সের ভিকটিম ইফেক্ট অনুযায়ী, মানুষ যদি একটা জিনিস বারবার ভিকটিম হতে দেখে তাহলে সে একসময় ধারণা করে নেয় এটাই সত্য। অথবা মিডিয়া যদি কোন মিথ্যাকে আমাদের সামনে বারবার সত্য হিসেবে তুলে ধরে একসময় আমরা সেটাকে সত্য হিসেবে গণ্য করি। উক্ত গানের মতো আরো অনেক নাটক-চলচ্চিত্র, শর্ট ফিল্মের বিভিন্ন ডায়লগ নারীদেরকে হেয় করে বানানো হচ্ছে। একজন শিশু যখন তার জন্মের পর থেকে এই সকল ঘটনা বারবার দেখে আসছে তখন তার ভেতর ভিকটিম ইফেক্ট কাজ করে এবং ধারণা করে নেয় যৌন হয়রানি একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। যেমনটা ফুলার রোড ঘটে যাওয়া ঘটনা কিশোরদের কাছে অতি স্বাভাবিক মনে হয়েছে এবং বাস্তবতার প্রয়োগ করেছে ।

এরকম আরো শত শত ঘটনা আছে যেমন ভারতের এক টেলিভিশন কর্তৃক পরিচালিত সিআইডি অনুষ্ঠান দেখে চুরি বা হত্যার পরিকল্পনায় ইত্যাদি। কিছুদিন আগে হাওয়া সিনেমায় পাখি হত্যা কে কেন্দ্র করে একটা মামলা হয় এনিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া সমালোচনা হলেও বাস্তবে পাখি হত্যা একটি শিশুর সামাজিকীকরণের প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন এতে শিশুমনে ভাবনা আসতে পারে পশুপাখি হত্যা স্বাভাবিক ব্যাপার।

এখন নাটক সিনেমা ব্যবসা সফল করতে ইভটিজিং বা যৌন হয়রানি মতো সিন ব্যবহার করা হয়। সিনেমা-নাটকে মাদক সেবনের সিনের ক্ষেত্রে যেমন নিচে লিখে দেয়া হয় ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তেমন ইভটিজিং বা যৌন হয়রানি মূলক সিনের নিচে লেখা যেতে পারে যৌন হয়রানি আইন ও মানবতা বিরোধী।

সামাজিকীকরণের আরো বিভিন্ন এজেন্ট যেমন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন সংগঠন প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই শিশুকে অবচেতনভাবে যৌন হয়রানির শিক্ষা দেয়। এখন এইটুকু পরিষ্কার যৌন হয়রানির পেছনের মূল কারণ হলো আমাদের সমাজ এবং সামাজিকীকরণ ব্যবস্থা। যৌন হয়রানির মত বড় বড় অপরাধ প্রতিরোধে শুধুমাত্র আইন বা অপরাধীর দিকে মনোযোগ না দিয়ে সমাজের মুলে খেয়াল রাখতে হবে।

You might also like
Leave A Reply

Your email address will not be published.

  1. প্রচ্ছদ
  2. ক্যাম্পাস
  3. যৌন হয়রানির পেছনে দায়ী কে?

যৌন হয়রানির পেছনে দায়ী কে?

আহসান কবির, ঢাবিঃ যৌন হয়রানি আমাদের সমাজে এক প্রচলিত সমস্যা। প্রতিদিনের সংবাদপত্রের কিছু পরিচিত শিরোনাম থাকে। তারমধ্য যৌন হয়রানি নিয়ে শিরোনাম থাকাটা যেন আবশ্যক হয়ে গেছে।

যৌন সংক্রান্ত অবাঞ্চিত আবদারই যৌন হয়রানি। অনেকে হয়তো জানেনা যৌন হয়রানকারি অথবা ভুক্তভোগী যে কোন লিঙ্গের হতে পারে। আমরা যৌন হয়রানি শব্দটি মূলত স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ হিসেবে ব্যবহার করে থাকি। যেমন প্রোপাগান্ডা শব্দটির অর্থ হলো প্রচার কিন্তু আমরা এটাকে অপপ্রচার অর্থে ব্যবহার করি। অর্থাৎ শব্দটিকে নারীবাচক করে ফেলেছি। যৌন হয়রানি শব্দটি উচ্চারিত হলেই মস্তিষ্কে নারী কল্পনা ফুটে ওঠে। এর পেছনে মূলত কারণ আমাদের পুরুষ নিয়ন্ত্রিত সমাজ বা পুরুষতান্ত্রিকতা।

যৌন হয়রানির শিকার হয়নি এমন মেয়ে পৃথিবীতে আছে কিনা জানা নেই। কেউ প্রকাশ করে, কেউ প্রকাশ করেনা। আবার অনেকেই বুঝেনা সে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে কিনা। আমরা সহজ-সরল বাঙালি গ্রাম্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শালী-দুলাভাই বিয়াই বিয়াইন একে অপরকে কটুক্তি করবেন গায়ে হাত দিবে এগুলো যেন প্রথা।

সাজিদা ফাউন্ডেশন এর মতে, পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার এবং ৭ শতাংশনারী জীবনের কোনো না কোনো এক সময় ধর্ষণের শিকার হয়। বাংলাদেশ ৮৪ শতাংশ নারী নিয়মিত রাস্তাঘাট, যানবাহন, মার্কেট এমনকি বাড়িতেও যৌন হয়রানির শিকার হয়। বাসে যাত্রী,বাসের হেল্পার ড্রাইভার দ্বারা ৪১ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে।

এইতো গত বছর ২৫ শে আগস্ট বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে জাকিয়া সুলতানা রুপা চলন্ত বাসে ধর্ষণের শিকার হয় এবং পরবর্তীতে তাকে হত্যা করা হয়। একই বছর ১০ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংয়ের ভালুকায় ১৩ বছরের এক কিশোরী বাসে আবার যৌন হয়রানির শিকার হয়। এবছর ৪ আগস্ট কুষ্টিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জগামী ঈগল এক্সপ্রেসের চলন্ত বাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ডাকাতির পাশাপাশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বলে যাত্রীদের বয়ানে তথ্য উঠে এসেছে। গত ১৭ জুলাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজ সহপাঠী কর্তৃক যৌন হয়রানির শিকার হয়, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী।

এখন প্রশ্ন হলো যেহেতু এটি একটি মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি এবং এর বিপরীতে আইনের ব্যবস্থাও আছে। তারপরও কেন? কেন বর্তমানে আরও মারাত্মক রূপ ধারণ করছে? এর মূল সমস্যাটা কোথায়? হয়তো অনেকেই বলবেন কঠোর শাস্তির অভাব। তবে যারা অপরাধ করছে। তাদেরকে শাস্তি দিয়েই যদি কোনো ফলাফল পাওয়া যেত তবে এতদিনে আমাদের সমাজ থেকে যৌন হয়রানির মতন অন্যান্য অপরাধপ্রবণতা হয়তো কমে যেত।

শাস্তি সমাজের থেকে অপরাধ দূর করতে পারেনা। শাস্তি কে বলা যেতে পারে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমিক ধাপ। আইন আদালতের মাধ্যমে হয়তো কোনো অপরাধ প্রবণতাকে কিছুদিনের জন্য দমিয়ে রাখা যেতে পারে কিন্তু কিছুদিন পরে আবারো একই অবস্থা দেখা যায়।

এটা প্রমাণিত যে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের দ্বিতীয় মাধ্যম বা আইন আদালতের মাধ্যমে অপরাধ প্রবণতা বন্ধ করা যায় না। যৌন হয়রানির মতো সকল অপরাধকে দূর করতে সমাজের মূলে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন আমাদের সমাজ ও সামাজিকরণ পদ্ধতিতে। যেহেতু এটি একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য মানুষ যেটা দেখে বা শেখে সেটা বাস্তবে প্রয়োগ করার চেষ্টা করে। সামাজিকীকরণের প্রধান মাধ্যম হলো পরিবার। পরিবার অবচেতনভাবেই একটি শিশুকে শেখায় নারীকে অবমাননা করতে হবে, সংকীর্ণ করতে হবে এবং সব সময় তাদেরকে অবদমন করে রাখতে হবে।

২০ বছরের একটা মেয়ে যখন বাইরে বের হয় তখন তার সুরক্ষা প্রদান করার জন্য চতুর্থ শ্রেণীতে পড়া তার ভাইকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এটা দ্বারা প্রমাণ করছি ২০ বছর বয়সী মেয়েটিও চতুর্থ শ্রেণীতে পড়া ছেলেটির থেকেও দুর্বল। ফলে আমরা সামাজিকীকরণের মাধ্যমে একটি শিশুকে অবচেতনভাবে এইটুকু জানিয়ে ফেলছি যে নারীরা আমাদের সমাজে অরক্ষিত এবং দুর্বল।

পাশাপাশি একটা শিশু তার জন্মের পর থেকেই বেড়ে ওঠা পর্যন্ত পরিবারের ভিতর দেখে আসে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, বিচার-সালিশ ইত্যাদিতে পুরুষ সদস্যদের প্রভাব। নারী সদস্যদের অবস্থান সেখানে নেই বললেই চলে। একটা শিশু যখন এই পরিস্থিতি দেখে তখন অবচেতনভাবেই তার মস্তিষ্কে গৃহীত হয়ে যায় নারীরা মতামত প্রকাশের কেউ না।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রামীন পরিবারে অকথ্য ভাষায় গালাগালি বা মারধর ঘটলে পুরুষ যদি দোষীও হয় দোষটা গিয়ে পড়ে নারীর উপর। মেয়ের বাড়ির লোকজন এসেও মেয়েকে দোষারোপ করবে। শেষ-মেষ পুরুষের মেল ইগোকে কদর করে, অনেক কাকুতি-মিনতি করে মেয়ের বাবার বাড়ির লোকজন মিলিয়ে দিয়ে যাবে। এই বিষয়ে যখন একটা সন্তান দেখছে তখন সেও মনে মনে এই মেল ইগো লালন করে এবং ভবিষ্যৎ জীবনে প্রয়োগ করার জন্য উৎসাহিত হয়।

বর্তমান সময়ে সামাজিকরনের সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী মাধ্যম হল মিডিয়া।নগরায়নের ফলে পরিবারগুলো যৌথ পরিবার থেকে ভেঙে গিয়ে অনু পরিবারে পরিণত হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাবা-মা দুজনই কর্মজীবী হওয়ায়, শিশুরা টেলিভিশন ও মোবাইল ফোনের মত ডিভাইসের সাথে বেশি সময় কাটাচ্ছে। বর্তমানে সকল সিনেমা বা অন্যান্য টেলিভিশন প্রোগ্রাম ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে তৈরি হচ্ছে। পারিবারিক শো পাওয়া খুবই দুষ্কর। সে ক্ষেত্রে ভাষা আচার-আচরণ এবং সিনেমায় হিরো হিরোইনদের উপস্থাপন বিশেষ করে নারী অভিনেত্রীদের কে আবেদনময়ী উপস্থাপন।পাশাপাশি নারী অভিনেত্রীকে ইফটিজিং, ওর্না ধরে টান , বিভিন্ন ধরনের লাইন এমনকি ধর্ষণের মতন ঘটনা তো থাকবেই। শিশু যখন এই জিনিসগুলো দেখে এবং সামাজিকীকরণের অংশ হিসেবে তারা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করবে এটাই স্বাভাবিক।।

মিডিয়া আমাদেরকে অবচেতনভাবে বিভিন্ন অশোভন আচরণের দিকে উস্কে দেয়। একটা বাস্তব অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেই বুঝতে অনেক সহজ হবে। গত কয়েকদিন ধরেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্কুল পোশাক পরিহিত অবস্থায় একটা গান ঘুরে বেড়াতে দেখছি। “বরিশালের পেয়ারা মেয়েদের কি চেহারা, ও মামনি একটু দাঁড়াও না ছোট্ট করে আমার গালে হাম দিয়ে যাওনা”। একদিন দেখলাম স্কুলপড়ুয়া কিছু শিক্ষার্থী ফুলার রোড দিয়ে হেটে যাচ্ছে এবং স্কুল পোশাক পরিহিত ছাত্রীদের উদ্দেশ্য করে উক্ত গানটি পরিবেশন করছে।

মিডিয়া ভায়োলেন্সের ভিকটিম ইফেক্ট অনুযায়ী, মানুষ যদি একটা জিনিস বারবার ভিকটিম হতে দেখে তাহলে সে একসময় ধারণা করে নেয় এটাই সত্য। অথবা মিডিয়া যদি কোন মিথ্যাকে আমাদের সামনে বারবার সত্য হিসেবে তুলে ধরে একসময় আমরা সেটাকে সত্য হিসেবে গণ্য করি। উক্ত গানের মতো আরো অনেক নাটক-চলচ্চিত্র, শর্ট ফিল্মের বিভিন্ন ডায়লগ নারীদেরকে হেয় করে বানানো হচ্ছে। একজন শিশু যখন তার জন্মের পর থেকে এই সকল ঘটনা বারবার দেখে আসছে তখন তার ভেতর ভিকটিম ইফেক্ট কাজ করে এবং ধারণা করে নেয় যৌন হয়রানি একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। যেমনটা ফুলার রোড ঘটে যাওয়া ঘটনা কিশোরদের কাছে অতি স্বাভাবিক মনে হয়েছে এবং বাস্তবতার প্রয়োগ করেছে ।

এরকম আরো শত শত ঘটনা আছে যেমন ভারতের এক টেলিভিশন কর্তৃক পরিচালিত সিআইডি অনুষ্ঠান দেখে চুরি বা হত্যার পরিকল্পনায় ইত্যাদি। কিছুদিন আগে হাওয়া সিনেমায় পাখি হত্যা কে কেন্দ্র করে একটা মামলা হয় এনিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া সমালোচনা হলেও বাস্তবে পাখি হত্যা একটি শিশুর সামাজিকীকরণের প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন এতে শিশুমনে ভাবনা আসতে পারে পশুপাখি হত্যা স্বাভাবিক ব্যাপার।

এখন নাটক সিনেমা ব্যবসা সফল করতে ইভটিজিং বা যৌন হয়রানি মতো সিন ব্যবহার করা হয়। সিনেমা-নাটকে মাদক সেবনের সিনের ক্ষেত্রে যেমন নিচে লিখে দেয়া হয় ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তেমন ইভটিজিং বা যৌন হয়রানি মূলক সিনের নিচে লেখা যেতে পারে যৌন হয়রানি আইন ও মানবতা বিরোধী।

সামাজিকীকরণের আরো বিভিন্ন এজেন্ট যেমন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন সংগঠন প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই শিশুকে অবচেতনভাবে যৌন হয়রানির শিক্ষা দেয়। এখন এইটুকু পরিষ্কার যৌন হয়রানির পেছনের মূল কারণ হলো আমাদের সমাজ এবং সামাজিকীকরণ ব্যবস্থা। যৌন হয়রানির মত বড় বড় অপরাধ প্রতিরোধে শুধুমাত্র আইন বা অপরাধীর দিকে মনোযোগ না দিয়ে সমাজের মুলে খেয়াল রাখতে হবে।

পাঠকের পছন্দ

মন্তব্য করুন