সাকিবুল ইসলাম, জবি প্রতিনিধি: জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) ক্যাম্পাসে গণহত্যার নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেশের একমাত্র গুচ্ছ ভাস্কর্য ৭১ এর গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি।
ভাস্কর্যটির নাম ৭১ এর গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিরীহ বাঙালিদের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) উপর বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্থানি হানাদার বাহিনী। সেই কালো রাতের নিরব সাক্ষী হিসেবে দাড়িয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ ভাস্কর্য একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে এটিই ।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মূলফটক দিয়ে ভিতরে ঢুকলেই দেখা যায় শান্ত চত্বরে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে ভাস্কর্যটি। এটি তৈরী করেছেন খ্যাতনামা শিল্পী ভাস্কর রাসা। সহকারী ভাস্কর হিসেবে ছিলেন রাজিব সিদ্দিকী, রুমী সিদ্দিকী, ইব্রাহীম খলিলুর রহমান এবং মিয়া মালেক রেদোয়ান।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষদেরকে ধরে এনে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ভেতরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হতাে। হত্যার পর লাশের স্তুপ সাজিয়ে গণকবর দেয়া হতাে বর্তমান ভাস্কর্যটির নিচে। পরে সেই নির্মম হত্যাযজ্ঞের স্মারক হিসেবে গণকবরের ওপরে এ ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে।
এ ভাস্কর্যটিতে মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যা ও যুদ্ধের প্রস্তুতির চিত্র ফুটে উঠেছে। ভাস্কর্যটি দুটি অংশে বিভক্ত। এর এক অংশে রয়েছে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি আর অপর অংশে রয়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম গণহত্যার চিত্র।
ভাস্কর্যটির যে অংশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম গণহত্যার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, সেখানে বেদনার জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ২৫ মার্চের কালরাতকে। এ অংশে দেখানাে হয়েছে- এই রাতে ইয়াহিয়া খান মাতাল অবস্থায় আছেন, পাকিস্তানির হানাদাররা হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে, গর্ভবতী মাকে অত্যাচার করে হত্যা করা হচ্ছে, লাশ ফেলে রাখা হচ্ছে যেখানে সেখানে। ভাস্কর্যের অংশ হিসেবে রয়েছে একটি পত্রশূন্য বৃক্ষ। তার ওপর একটি শকুন বসে আছে। এর দ্বারা সে সময়ে শ্মশান হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের প্রতীক বােঝানাে হয়েছে।
আর অপর অংশে রয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির চিত্র। বাংলার কামার, কুমার, জেলে, কৃষিজীবী মানুষ মােট কথা সর্বস্তরের মানুষ একত্রিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে লড়ছে। দা, বটি, খুন্তি, কোচ, বর্শা সবকিছু নিয়ে যুদ্ধের মুখােমুখি হয়েছেন তারা। পরের অংশে দেখা যায়, সবাই আধুনিক অস্ত্র নিয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। যুদ্ধে নামার পর যখন যােদ্ধারা বুঝতে পারেন যে, পুরনাে পদ্ধতি দিয়ে তাদের সঙ্গে পেরে ওঠা সম্ভব নয়, তখন সবাই প্রশিক্ষণ নেয়া শুরু করেন, যেখানে রয়েছে সব বয়সী নারী-পুরুষ। পরিপূর্ণ যুদ্ধের জন্য গেরিলা কৌশল, মাঝারি আকারের অস্ত্রের ব্যবহার শিখছেন তারা। ভাস্কর্যের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে প্রশিক্ষণ নেয়া সাহসী এক কৃষকের ছেলে। তার চোখে যুদ্ধজয়ের নেশা। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিতে সবার চোখে প্রতিশােধস্পৃহার ছাপ রয়েছে। ভাস্কর্যে সবার মাথা একটা সােজা, মুখ লালবর্ণের। এর কারণ রাগ হলে কালাে মানুষের চেহারাও লালবর্ণ ধারণ করে। আবার অন্যদিকে গণহত্যার দৃশ্যের রঙ ধূসর, কারণ এটি আমাদের বেদনাদায়ক স্মৃতি।
ভাস্কর্যটির নিচে রয়েছে পানি, যা দিয়ে নদীমাতৃক বাংলাদেশকে বােঝানাে হয়েছে। আর পানির ভেতরে রয়েছে বাংলা বর্ণমালা, যা দিয়ে ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে তুলে ধরা হয়েছে। এতে বােঝানাে হয়েছে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সফলতায় বাংলার মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার ভাবনা আসে।
উল্লেখ্য, ১৯৮৮ সালে ভাস্কর্যটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। আর শেষ হয় ১৯৯১ সালে। ২০০৮ সালের ৩১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম খান এটি উদ্বোধন করেন। ভাস্কর্যটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটক দিয়ে ঢুকলেই সামনে পড়ায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা যে কারো প্রথমেই এটি চোখে পড়ে। এটি সকলকে একাত্তরের হানাদার বাহিনীর বর্বরতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।