The Rising Campus
Education, Scholarship, Job, Campus and Youth
বৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪

মব জাস্টিস নাকি হত্যার উৎসব!

এইচ. এম. মশিউর রহমান: ২০০৩ সালের এক বিকালের ঘটনা। রাজধানীর পান্থপথ মোড়ে ছিনতাইকারী সন্দেহে তিন যুবককে হাত-পা বেঁধে শত শত মানুষের সামনে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়। সে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য! চারপাশে তখন রীতিমতো জটলা বেঁধে যায়। কেউ কেউ হাততালিও দিচ্ছিলেন! দর্শক সারিতে দুয়েকজন পুলিশ সদস্যকেও দেখা যায়। গায়ে কেরোসিন বা পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগানো, তারপর দগ্ধ ব্যক্তিদের আর্তচিৎকার এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া- শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো দৃশ্যই ধরা পড়ে সে সময় একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের ক্যামেরায়। সেটি প্রচারও হয়। ঘটনাটি ওই সময়ের আলোচিত প্রসঙ্গ হয়ে ওঠে।

২০১১ সালের ১৭ জুলাই। শবেবরাতের রাত। রাজধানীর ধানমন্ডির ম্যাপললিফ স্কুলের ছাত্র শামস, মিরপুর বাঙলা কলেজের ইব্রাহিম, কামরুজ্জামান, পলাশ; তেজগাঁও কলেজের টিপু ও মিরপুরের বিইউবিটির সিতাব জাবীর মুনিব। ওরা ছয় বন্ধু। সেই রাতে সাভারের আমিনবাজারে ঘুরতে গেলে ডাকাত সন্দেহে গণধোলাই দিয়ে ছয়জনকেই পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় ২০২১ সালের ২ ডিসেম্বর ১৩ জনের মৃত্যুদণ্ড ও ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত।

মাত্র ১০ দিন পর, অর্থাৎ একই বছরের ২৭ জুলাই নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের চরকাঁকড়ায় পুলিশের গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে জনতার মাঝে ফেলে দিয়ে মিলন নামে এক কিশোরকে গণধোলাইয়ের বলি বানানো হয়। বলা হয় মিলন ডাকাত দলের সদস্য ছিল। ওই ঘটনায় কয়েকজন পুলিশকে সাসপেন্ড করা হয়েছিল।

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গণপিটুনিতে ৮০০ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। এরপর গত সাড়ে ছয় বছরে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে আরও অন্তত ২৮৬ জন। এর মধ্যে ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর গত ৭ মাসে (জানুয়ারি-জুলাই) গণপিটুনিতে নিহতের সংখ্যা ৩২। এর মধ্যে ঢাকাতেই নিহত হয় ১৬ জন।

বিগত কিছুদিন যাবৎ সেই একই পুরোনো আলোচিত মব জাস্টিস নামক জনগণের গণপিটুনির মাধ্যমে গণ- বিচার নামক মব জাস্টিস আলোচনায় এসেছে। মব (mob) অর্থ উত্তাল জনতা বা উচ্ছৃঙ্খল জনতা। জাস্টিস (Justice) অর্থ বিচার বা ন্যায়বিচার। ‘মব জাস্টিস’ অর্থ উত্তাল জনতা বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার বিচার। সাধারণভাবে বোঝায়, জনতা আইন বা আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে কোনো বিচার নিজ হাতে যখন তুলে নেয়, তখন সেটাই হয় মব জাস্টিস। এ ধরনের ঘটনায় যদি কেউ মারা যায় বা জনতার পিটুনিতে কারও মৃত্যু হলে ওই পরিস্থিতিকে বলা হয় লিঞ্চিং (lynching)। এটাও এক ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। এ ছাড়া উচ্ছৃঙ্খল জনতা দ্বারা বাড়িঘর পোড়ানো, কাউকে আহত করা, ভাঙচুর সবকিছুই মব জাস্টিসের অংশ।

মব জাস্টিসের সাম্প্রতিক উদাহরণ হিসেবে সামনে আসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদকে (৩১) পিটিয়ে হত্যার ঘটনা। গত ৭ সেপ্টেম্বর রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন বিনোদপুর বাজারে মাসুদের ওপর হামলা হয়। পরে তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় থানায় সোপর্দ করা হয়। এরপর হাসপাতালে নেওয়া হলে রাত সাড়ে ১২টার দিকে তিনি মারা যান।

তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে মোবাইল চোর অভিযোগে ব্যাপক পিটুনিতে মেরে ফেলা হয় তোফাজ্জল হোসেন নামে এক যুবকে।

হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহ মোহাম্মদ মাসুম গণমাধ্যমকে বলেন, তোফাজ্জলকে হলের ভেতরে আটকে রেখে মারধর করেন শিক্ষার্থীরা। হামলার পর হল কর্তৃপক্ষ তোফাজ্জলকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিমের কাছে হস্তান্তর করে। তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসার পরিবর্তে প্রক্টরিয়াল টিম তাকে শাহবাগ থানায় নিয়ে যায়। পরে পুলিশের পরামর্শে হাসপাতালে নেওয়া হলে রাত পৌনে ১২টার দিকে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

একই দিনে এ ঘটনার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্মত্ততার শিকার হয়ে মারা যান জাবি শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম মোল্লা। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে হামলা ও ভাঙচুরের অভিযোগ এনে বুধবার বিকালে তাকে মারধর করে একদল শিক্ষার্থী। পরে তাকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়। রাতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান শামীম। এই ঘটনার প্রতিবাদে গতকাল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন।

এরপরে গাজীপুরে, চট্টগ্রামে ও দেশের আরো অনেক জায়গায় ঘটেছে জনতার একযোগে আক্রমণের পালা। মানুষকে বেধড়ক মারধর করতে দেখা গেছে অনেক জায়গায়। যা একটি রাষ্ট্রের ভবিষৎ এর আইনি বিশ্বাসের ক্ষেত্রে খুবই ভয়াবহ ব্যাপার৷ মানুষ কখনই এমন রাষ্ট্র চায়না যেখানে মানুষ মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে। মানুষ সব সময় একটি বিশ্বাসযোগ্য রাষ্ট্রের কামনা করে যেখানে সে অবাধে বিচরণ করতে পারে।

জনতা যদি আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে মানুষকে এভাবে মেরে রাষ্ট্রকে শুদ্ধ করতে চায় তাহলে শুদ্ধতার পরিবর্তে তৈরি হবে ভয়ংকর অরাজকতা। মানুষ মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে সামাজিক অবক্ষয়ের মাধ্যমে গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটবে এবং আমরা ক্রমান্বয়ে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাবো। তাই অবশ্যই রাষ্ট্রকে এই সকল বিষয়ে যথাযথ সুদক্ষ নজর দিয়ে মব জাস্টিস নামক জনতার এই মৃত্যুর বিভৎস কৌতূহলের উৎসবকে শক্ত হাতে দমন করতে হবে। আর এর ভেতর দিয়েই মানুষের আইন ও রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা হওয়া সম্ভব।

লেখক: অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ঢাকা।

You might also like
Leave A Reply

Your email address will not be published.