ঢাকা কলেজের ইতিহাস বিভাগের একজন শিক্ষক আট বছর আগে সহযোগী অধ্যাপক হয়ে এখনো সেই পদে রয়েছেন। তিনি জানান, অধ্যাপকের পর্যাপ্ত পদ না থাকায় তাঁকে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে না।
অভিযোগ রয়েছে, প্রশাসন, পুলিশ, পররাষ্ট্রসহ কয়েকটি ক্যাডার বাদে অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সময়মতো পদোন্নতি হয় না। এর মূল কারণ হলো এসব ক্যাডারে পদসংখ্যার বাইরে পদোন্নতি দেওয়া হয় না। কিন্তু জনপ্রশাসনসহ আরও কয়েকটি ক্ষেত্রে পদের বাইরেও পদোন্নতি দেওয়া হয়।
সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে ২৬টি ক্যাডারে কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব ক্যাডারের মধ্যে পদোন্নতি ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে বৈষম্য আছে।
কর্মকর্তাদের সংখ্যার দিক দিয়ে বিসিএস স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্যাডার বড়। বর্তমানে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে মোট পদ আছে ১৫ হাজার ৭৭৪টি। এর মধ্যে ৩ হাজার ৫৩১টি পদ শূন্য। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের অধিকাংশই সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করছেন। কিছুসংখ্যক কর্মকর্তা শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরত।
২৬তম বিসিএসে ২০০৬ সালে চাকরি পাওয়া ঢাকা কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের একজন সহকারী অধ্যাপক নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত বিভাগীয় পরীক্ষা ও বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদন (এসিআর) ঠিক থাকলে প্রভাষক পদে চার বছর চাকরির পর সহকারী অধ্যাপক হওয়ার জন্য যোগ্য হন কলেজ শিক্ষকেরা। কিন্তু তাঁরা পদোন্নতি পান আট বছর চাকরির পর ২০১৪ সালে। সহকারী অধ্যাপক পদে তিন বছর চাকরি করলে সহযোগী অধ্যাপক হওয়া যায়। কিন্তু প্রায় আট বছর হয়ে গেলেও তিনি এখনো সহকারী অধ্যাপক পদেই রয়ে গেছেন।
ঢাকা কলেজের এই শিক্ষক এখন বেতন পান জাতীয় বেতন কাঠামোর ষষ্ঠ গ্রেডে। তিনি বলেন, তিনি যে বিসিএসে নিয়োগ পেয়েছেন, তার পরের বিসিএসে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পঞ্চম গ্রেডে বেতন পাচ্ছেন।
শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের আগে তৃতীয় গ্রেড পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু ২০১৫ সালের জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী, তাঁরা যেতে পারেন সর্বোচ্চ চতুর্থ গ্রেড পর্যন্ত। ফলে এখন পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে এই যে শিক্ষা ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক নেহাল আহমেদ রয়েছেন চতুর্থ গ্রেডে, আবার সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপকেরাও একই গ্রেডে বেতন পান।
মাউশির মহাপরিচালকের পদটি গ্রেড-১ করা হয়েছিল। কিন্তু শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা যেহেতু চতুর্থ গ্রেডের ওপরে যেতে পারেন না, তাই ৩ ও ২ নম্বর গ্রেড ডিঙিয়ে তাঁদের গ্রেড-১-এ যাওয়ার সুযোগ একেবারেই কম। মাউশির সর্বশেষ তিনজন মহাপরিচালকের কেউ গ্রেড-১-এ যেতে পারেননি।
এদিকে দেশের ৯৫টি বড় সরকারি কলেজের অধ্যক্ষের পদ গ্রেড-৩-এ উন্নীত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে গত জুনে। উচ্চতর পদে পদোন্নতি-সংক্রান্ত সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) মাধ্যমে এ পদে যেতে হবে। তবে বোর্ডের সভা এখনো হয়নি।
মাউশির পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) ও বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সভাপতি শাহেদুল খবীর চৌধুরী বলেন, অন্যদের মতো ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতি ও পদ সৃষ্টি হলে শিক্ষকদের সমস্যা কমবে।
চিকিৎসকদের আক্ষেপ
স্বাস্থ্য ক্যাডারের চিকিৎসকেরাও পদোন্নতিতে পিছিয়ে আছেন। বর্তমানে স্বাস্থ্য ক্যাডারে ২৮ হাজারের মতো চিকিৎসক রয়েছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ মো. টিটু মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, প্রশাসন, পুলিশসহ কয়েকটি ক্যাডারে বিসিএসের ব্যাচ ধরে পদোন্নতি হয়। চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে সেটি হয় না। তাঁদের পদ অনুযায়ী পদোন্নতি হয়। এখন পদোন্নতির গতি আগের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে। তবে পদোন্নতিসংক্রান্ত সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) বা বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটির (ডিপিসি) সভা নিয়মিত হয় না। তিনি বলেন, বিষয়ভিত্তিক পদের ক্ষেত্রেও সমন্বয় আনা দরকার।
চিকিৎসকেরা জাতীয় বেতন কাঠামোর তৃতীয় গ্রেড পর্যন্ত যেতে পারেন। শুধু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পদটি গ্রেড-১ এর। চিকিৎসকেরা বলছেন, পদোন্নতির ক্ষেত্রে সব ক্যাডারে কাছাকাছি নিয়ম করে ভারসাম্য আনা দরকার। নইলে বৈষম্য বাড়তে থাকবে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক জানান, তিনি এখন সহকারী অধ্যাপক। সাধারণত চাকরির পাঁচ বছর হওয়ার পর শর্তগুলো পূরণ করলেই ষষ্ঠ গ্রেডে যাওয়ার কথা। কিন্তু এ গ্রেডে যেহেতু পদ কম, ফলে সময়মতো তাঁরা পদোন্নতি পান না। তাঁর পদোন্নতিতে লেগেছিল প্রায় সাত বছর। কিন্তু অনেকের আরও বেশি সময় লাগে।
‘সব ক্যাডারে যোগ্যদের পদোন্নতি দেওয়া উচিত’
আন্তক্যাডার বৈষম্য নিয়ে মাঝেমধ্যেই সরব হয় প্রকৌশলী, কৃষিবিদ ও চিকিৎসকদের নিয়ে গঠিত সংগঠন প্রকৃচি। তাঁদের সঙ্গে বিভিন্ন ক্যাডারের সমন্বয়ে গঠিত বিসিএস সমন্বয় কমিটিও কখনো কখনো এ নিয়ে কর্মসূচি পালন করে। সর্বশেষ ২০১৬ সালে ‘সিলেকশন গ্রেড’ ও ‘টাইম স্কেল’ পুনর্বহাল এবং ক্যাডার-নন ক্যাডার বৈষম্য দূরীকরণের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিলেন তাঁরা।
বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (পিএটিসি) সাবেক রেক্টর এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, প্রশাসন ও পুলিশের ছাড়া অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা যেসব কথা বলেন, তার কিছু বিষয় যৌক্তিক এবং কিছু বিষয় অযৌক্তিক। অনেক সময় বিভিন্ন ক্যাডারের যৌক্তিক প্রস্তাবও মন্ত্রণালয়গুলো গুরুত্ব দেয় না। তিনি বলেন, সব ক্যাডারে শুধু পদ শূন্য হলে যোগ্য ও মেধাবী কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়া উচিত।