মো: সবুজ হোসেন: আজ ১০ ডিসেম্বর,২০২৪ বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। সর্বজনীন মানবাধিকার দিবস ঘোষণার ৭৬ বছর পূর্তির দিনটিতে আজ বিশ্বব্যাপী নানা কর্মসূচি পালিত হবে। বিশেষ করে দেশে দেশে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অর্জন ও লঙ্ঘনের দিকগুলো যারা পর্যবেক্ষণ করেন তারা এবং বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান মূল্যবান প্রতিবেদন প্রকাশ, তথ্য ও তত্ত্বকথা উপস্থাপন করেন, তাদের সবার কাছে দিনটি সবিশেষ গুরুত্ববহ। কিন্তু মানবাধিকার শুধুই প্রতিবেদন প্রকাশ,তথ্য ও তত্ত্বকথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ,, বাস্তবিক অর্থে এখনো পযর্ন্ত বিশ্বজুড়ে সুষম মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় নি।
জাতিসংঘের সংজ্ঞা মতে, ”মানবাধিকার হলো মানব পরিবারের সকল সদস্যের জন্য সার্বজনীন, সহজাত, অহস্তান্তরযোগ্য এবং অলঙ্ঘনীয় অধিকারই হলো মানবাধিকার। মানবাধিকার প্রতিটি মানুষের এক ধরনের অধিকার যেটা তার জন্মগত ও অবিচ্ছেদ্য।”
বিশ্বব্যাপী প্রতিটি মানুষের মানবাধিকার নিশ্চিত করার জন্য ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণা পত্রে ৩০ টি ধারা রয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে এই ঘোষণার ৭৬ বছর পার হয়ে গেলেও এখনো বিশ্ব ব্যাপী যে সুষম মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। যেমন এই ঘোষণাপত্রের ধারা ৪ এ বলা হয়েছে, ”কাউকে অধীনতা বা দাসত্বে আবদ্ধ করা যাবে না। সকল প্রকার ক্রীতদাস প্রথা এবং দাসব্যবসা নিষিদ্ধ করা হবে”। কিন্তু মানব পাচার , শ্রম , যৌন শোষণ বা ক্রিয়াকলাপের উদ্দেশ্যে বলপ্রয়োগ বা প্রতারণার মাধ্যমে ব্যক্তিদের অবৈধ পরিবহন জড়িত আধুনিক দিনের দাসত্বের ধরন যেখানে অন্যরা আর্থিকভাবে লাভবান হয়।ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে বিশ্বে পাচারের শিকার হওয়া মানুষের মধ্যে ৭০ শতাংশই নারী ও কিশোরী। প্রধানত যৌন ব্যবসা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে নেয়ার উদ্দেশ্যেই এদের পাচার করা হয়ে থাকে।প্রতিবেদনে আরো দেখা যায় যে , মানব পাচারকারীরা সারা বিশ্বেই নারী ও কিশোরীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে চলেছে। শনাক্তকৃত ভুক্তভোগীদের মধ্যে প্রায় তিন-চতুর্থাংশই যৌন নিপীড়নের সম্মুখীন হয়। এর পাশাপাশি ৩৫ শতাংশ নারীকে জোরপূর্বক শ্রমিক বানানো হয়। সাধারণত এইসব নারীদেরকে অনুন্নত দেশ থেকে দেশ থেকে যোগাড় করা হয় এবং পাচার করা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশে।
প্রতিটি শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে তখন সে সম্মান ও অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। বর্তমান বিশ্বে লক্ষ লক্ষ শিশু তাদের মৌল মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যে সময়ে একটি শিশুর স্কুলের যাওয়ার কথা সে সময়ে সে কলকারখানা বা ইটের ভাটায় কিংরা টেনারিতে কাজ করছে।২০২৪সালের হিসাবে , বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলিতে, প্রায় পাঁচজন শিশুর মধ্যে একজন শিশু শ্রমে নিয়োজিত, যাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সাব-সাহারান আফ্রিকায় বসবাস করে , যেখানে চারজন শিশুর মধ্যে একজনের বেশি নিযুক্ত রয়েছে। ইউনিসেফের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ১৬ কোটিতে পৌঁছেছে। এদের মধ্যে ৭০% শিশু কৃষিখাতে, ২০% সেবাখাতে, এবং ১০% শিল্পখাতে কর্মরত। ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী শিশুরা বেশি ঝুঁকিতে আছে, যাদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ স্কুলের বাইরে। কোভিড-১৯ মহামারি এবং অর্থনৈতিক সংকটের পর এই প্রবণতা আরও বাড়িয়ে তুলেছে, যার ফলে অনেক পরিবার তাদের সন্তানদের শ্রমে নিযুক্ত করতে বাধ্য হচ্ছে। আফ্রিকার মতো অঞ্চলগুলিতে পরিস্থিতি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক।এছাড়াও কর্মস্থলে সে তার ন্যূনতম পারিশ্রমিকও পাচ্ছে না। এছাড়া পুষ্টি খাবার না খাওয়াতে সে অপুষ্টিতে ভুগছে। ২০২৪ সালের ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রায় ২৫ শতাংশ শিশু অপুষ্টির কারণে গুরুতর খাদ্য সমস্যার সম্মুখীন। এটি প্রায় ১৮১ মিলিয়ন শিশুকে বোঝায়, যারা জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাচ্ছে না।
বর্তমানে বিভিন্ন দেশের শরণার্থী শিবিরে মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ মানবেতর পরিবেশে জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। যেমন ২০১৭ সালের আগষ্ট মাসে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ১ মিলিয়ন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিজের দেশ থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারের আশ্রয় নেয়।বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গারা মানবেতর জীবনযাপন করছে, বিশেষ করে শিশু ও নারীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার। শিবিরগুলোতে নিরাপত্তা, পুষ্টি, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা ব্যবস্থা অপ্রতুল।এছাড়া মানবপাচার ও যৌন হয়রানির ঝুঁকিও এই জনগোষ্ঠীর জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সমস্যার ৭ বছর পেরিয়ে গেলোও এর সুষ্ঠু কোনো সমাধান দিতে পারে নি মানবাধিকার সংস্থা গুলো। এছাড়া জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে কোনো প্রস্তাব আনা হলেই ভেটো ক্ষমতার অধিকারী দেশ গুলো ভেটো প্রদান করার ফলে এই সমস্যার সমাধান করা যাচ্ছে না।
বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট হচ্ছে:যুদ্ধ এবং সংঘাত। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ইজরায়েল ও ফিলিস্তিন সংকট।১৯৪৮ সালে ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই সংকটের সূচনা হয় যা এখন পযর্ন্ত বিদ্যমান রয়েছে। এর মধ্যেই বিভিন্ন সময়ে ইজরায়েলি আগ্রাসনে ফিলিস্তিন নিজেদের মাতৃভূমিতে পরবাসী হয়ে পড়ে এবং নিজের ভূমি হারিয়ে ফেলে। কিন্তু বিশ্ব মোড়লরা এই সমস্যা সমাধানের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি বরং এই সংকটকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত এক ভয়াবহ মানবিক সংকটের রূপ নিয়েছে। গত অক্টোবরের শুরুর দিকে হামাসের আকস্মিক হামলায় ১,৪০০-এর বেশি ইসরায়েলি নিহত হন এবং বহু মানুষ আহত হন। এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় ব্যাপক বিমান হামলা চালায়। এতে প্রায় ৪,৩৮৫ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং ১০ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। গাজায় খাদ্য, পানি ও ওষুধের চরম সংকট দেখা দিয়েছে, যা জনস্বাস্থ্যের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
ইসরায়েলি হামলায় বহু শিশুও নিহত হয়েছে, এবং গাজার হাসপাতালগুলোতে আহতদের চিকিৎসা দেওয়ার পর্যাপ্ত সরঞ্জাম নেই। জাতিসংঘ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এই অবস্থাকে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। রাফাহ সীমান্ত দিয়ে কিছু ত্রাণ সরবরাহ করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
এই সংঘাত বন্ধে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত স্থায়ী সমাধান দেখা যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিতে পারে এবং আরও প্রাণহানির শঙ্কা রয়েছে।
রাশিয়া- ইউক্রেন এর মধ্যে যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার ফলে বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও জ্বালানি মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে অনুন্নত দেশগুলো তীব্র খাদ্য সংকটে ভুগছে এছাড়া যুদ্ধের ফলে যানমালের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এছাড়া সিরিয়া, ইয়েমেন ও সুদানের মতো দেশে যুদ্ধের ফলে ব্যাপক বেসামরিক ব্যক্তি নারী, শিশুর মৃত্যু হচ্ছে, যা মানবাধিকারের পরিপন্থী।
যে উদ্দেশ্যে সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা করা হয়েছিল এই বৈষম্যহীন মানবিক পৃথিবী গড়ে তোলা, সেই লক্ষ্য অর্জনে এই ঘোষণাপত্র ব্যর্থ হয়েছে।এই ঘোষণাপত্রকে সফল করে তোলার জন্য বিশ্ব মোড়লদের এগিয়ে আসতে হবে, কারণ হাতেই এই সমস্যা সমাধান করার চাবিকাঠি রয়েছে। সুতরাং বলা যায় যে বিশ্বের প্রতিটি দেশকে এগিয়ে আসতে হবে এই ঘোষণাপত্র সফল করার জন্য। সবার সম্মিলিত প্রয়াসে গড়ে তোলা সম্ভব মানবিক পৃথিবী এবং পূরণ করা সম্ভব সব ব্যক্তি মানবাধিকার।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।