The Rising Campus
Education, Scholarship, Job, Campus and Youth
রবিবার, ৬ই অক্টোবর, ২০২৪

বাঙলা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো বাঙলা কলেজ

এস. এম. মঈন উদ্দীন: উপমহাদেশে প্রথম ভাষাভিত্তিক কলেজ স্থাপিত হয় ১৯৪৯ সালে পাকিস্তানের করাচিতে। প্রতিষ্ঠার এক দশক পর ১৯৫৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের রাজধানী করাচিতে কলেজটির প্রতিষ্ঠাতা আবদুল হক ‘জাতীয় উর্দু কনফারেন্স’ শীর্ষক একটি সম্মেলনের আয়োজন করেন । প্রায় একই সময়ে ভাষাসংগ্রামী আবুল কাসেম ঢাকার কার্জন হলে আয়োজন করেন ‘বাংলা কনফারেন্স’। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পশ্চিম পাকিস্তানে উর্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে এর বিপরীতে পূর্ববঙ্গে বাংলা কলেজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন তিনি সেই সভায়।

এ সময় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ উর্দু উন্নয়ন সংস্থা পরিচালিত উর্দু অভিধান প্রকল্পের সম্পাদক হিসাবে প্রায় এক বছর করাচিতে অবস্থান করেন। পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা মাধ্যমে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কীভাবে গঠন করা যায়, তার ধারণাটা তিনি লাভ করেছিলেন করাচিতে অবস্থানকালে, ১৯৫৯-১৯৬০ কালপর্বে উর্দু অভিধান প্রকল্পের সম্পাদক নিযুক্ত হওয়ার পর। সে সময় করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন সৈয়দ আলী আহসান।

সৈয়দ আলী আহসান ঢাকায় ফিরে বাংলা একডেমিতে যোগদান করেন ১৯৬০ সালের ১৫ ডিসেম্বর। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ও ১৯৬১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে বাংলা একাডেমি কার্যালয়ে এসে ‘পূর্ব পাকিস্তানি ভাষার আদর্শ অভিধান’ প্রকল্পের সম্পাদক হিসাবে কাজ শুরু করেন। এর পরপরই বাংলা মিডিয়াম কলেজের ধারণাটা পাকাপোক্ত হতে শুরু করে।

১৯৬১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৩টায় বাংলা একাডেমির নবনির্মিত তিন তলার সভাকক্ষে বাঙলা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকে মূল লক্ষ হিসাবে সাব্যস্ত করে ‘পূর্ব পাকিস্তানে বাঙলা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা’ শিরোনামে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সভায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে বাঙলা কলেজ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯ ফেব্রুয়ারি খান বাহাদুর আবদুর রহমান খানের সভাপতিত্বে একই স্থানে অনুষ্ঠিত আরেকটি সভায় বাঙলা কলেজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৫১ সদস্যবিশিষ্ট একটি সাংগঠনিক কাউন্সিল গঠন করা হয়। কাউন্সিলে প্রধান পৃষ্ঠপোষক নির্বাচন করা হয় পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর লে. জেনারেল আজম খানকে। সহসভাপতি পদে মনোনয়ন লাভ করেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও খান বাহাদুর আবদুর রহমান খান; কোষাধ্যক্ষ পদে আবদুল হাকিম; সম্পাদক পদে প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ; যুগ্ম সম্পাদক পদে আবুল কাসেম। কলেজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই ছিলেন একইসঙ্গে সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের সক্রিয় সদস্য এবং বাংলা একাডেমি পরিচালনা পরিষদের সদস্য।

একই বছরের ১৮ জুন সভাসদগণ কলেজের কার্যক্রম ১৯৬১ সালের ১ জুলাই থেকে শুরু করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। কলেজের বিষয় ও শিক্ষা কার্যক্রম পরিকল্পনা করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমের আদলে। ১৯৬২ সালের ৪ মার্চে অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কলেজের স্থান নির্ধারণ করা হয় বকশিবাজারের নবকুমার ইনস্টিটিউটে।

১৯৬২ সালের ১ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে পালতোলা নৌকা খচিত মনোগ্রাম নিয়ে চালু হয় বাঙলা কলেজ। জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাংলা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাঙলা কলেজ প্রতিষ্ঠার এ পদক্ষেপকে এক কথায় বলা যায় প্রাথমিক ও বৈপ্লবিক দৃষ্টান্ত স্থাপন। কলেজের প্রথম পরিচালনা পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, সম্পাদক প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ এবং সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন খান বাহাদুর আব্দুর রহমান খান।

১৯৬৪ সালে অবাঙালি অধ্যুষিত মিরপুরের নতুন ভবনে স্থানান্তরিত হয় বাঙলা কলেজ। এরপর থেকেই শুরু হয় প্রতিষ্ঠানটির প্রকৃত অগ্নিপরীক্ষার কাল। শুধু পাঠ্যসূচি থেকে ইংরেজির অপসারণই নয়; বরং লোকালয়ের অলিগলিতে গিয়ে সাইনবোর্ড, ব্যানার, নামফলকে বাংলা প্রতিষ্ঠার কঠিন অভিযানে নেতৃত্ব দেয় প্রতিষ্ঠানটি। ১৯৭১ সালে স্থানীয় অবাঙালিরা বাঙলা কলেজের নামফলক তুলে তার জায়গায় বসিয়ে দেয় উর্দু কলেজের নামফলক। পাশাপাশি ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পুরোটা সময়জুড়েই পাক-হানাদার বাহিনির ক্যাম্পরূপে ব্যাবহৃত হয়েছিলো বাঙলা কলেজ। কলেজের প্রশাসনিক ভবনের কক্ষগুলো ছিলো হানাদার বাহিনির’ টর্চার সেল’৷ স্থানীয় মুক্তিকামী জনতাকে ধরে এনে পাশবিক কায়দায় নির্যাতন চালানো হতো এসব কক্ষে। কলেজ ক্যাম্পাসের কিছু জায়গায় গণকবরের সন্ধান মিলেছে পরবর্তীতে। সাম্প্রতিক সময়ে এরূপ ৯টি স্থানকে বধ্যভূমিরূপে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং ৩টি বধ্যভূমিতে স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে।

১৯৮৫ সালে বাঙলা কলেজকে জাতীয়করণ করা হয় ও নামের শুরুতে “সরকারি” শব্দটি যোগ হয়। উইকিপিডিয়ার তথ্যানুসারে বর্তমানে উচ্চ মাধ্যমিকের তিনটি বিভাগ এবং স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের চারটা অনুষদভুক্ত ১৯টা বিষয়ে প্রায় ত্রিশ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যায়ন করেন এ কলেজে। ৮টি একাডেমিক ভবন, দুইটি ছাত্রাবাস, নিজস্ব মসজিদ, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, একটি নিজস্ব লেক, একটি মুক্তিযুদ্ধ কর্নার, শিক্ষক-কর্মচারী আবাসিক এলাকা এবং সুবিশাল একটি খেলার মাঠ মিলিয়ে মোট ২৫ একর জমি নিয়ে রাজধানী ঢাকার বুকে সগৌরবে দাঁড়িয়ে রয়েছে সরকারি বাঙলা কলেজ।

পাকিস্তানের করাচিতে উর্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পর ২০০২ সালের ১৩ নভেম্বর উর্দু আর্টস কলেজ ও উর্দু সায়েন্স কলেজকে একীভূত করে প্রতিষ্ঠিত হয় ফেডারেল উর্দু ইউনিভার্সিটি অব আর্টস সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি। এটি পাকিস্তানের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে প্রধানত উর্দু মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া শুরু হয়। অথচ স্বাধীনতার পর বাঙলা কলেজ তার নামফলক ফিরে পেলেও আজও অবাস্তবায়িত বাঙলা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন-যার বীজ রোপিত হয়েছিল ৬২ বছর আগে।

স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে আমাদের দেশে অনেক কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। ২০০১ সালে বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউটকে শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হয়। ২০০৫ সালে জগন্নাথ কলেজকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ২০০৬ সালে সিলেট সরকারি ভেটেরিনারি কলেজকে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করা হয়। ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। শুধু জাতীয় গৌরবনির্দেশক ভাষা আন্দোলনের প্রতীক বাঙলা কলেজ আজও বিশ্ববিদ্যালয় হতে না পেরে পড়ে রয়েছে ব্যর্থদের তালিকায়।

বাঙালি জাতিয়তাবাদের অন্যতম মূল ভিত্তি বাংলা ভাষা। উপাদান হিসেবে এ জাতিয়তাবাদের অন্যান্য যেকোনো উপাদানের তুলনায় বাংলা ভাষা অত্যান্ত শক্তিশালী। বাংলা ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ফলে সংগঠিত হয় ১৯৫২ সালের সফল ভাষা আন্দোলন, যার পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালি ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ করে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। বাংলা ভাষা এখানে জাতীয়তাবাদের বাহনরূপে কাজ করেছে। বাংলা ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদী একটা রাষ্ট্রে জাতীয়তাবাদের বাহন বাংলা ভাষার কোনো বিশ্ববিদ্যালয় না থাকাটা দুঃখজনক। যে জাতি ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে প্রাণ দিয়েছে সে জাতির নিজস্ব ভাষায় পাঠদানের মতো কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা বিশ্ববিদ্যালয় না থাকার ব্যাপারটা অগৌরবের, লজ্জার। বাঙালি নিজের দেশে ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে ঠিকই; কিন্তু তার পরিপূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে নিজস্ব ভাষাভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় পিছিয়ে রয়েছে এখনো।

এক্ষেত্রে বাংলাদেশের তুলনায় এগিয়ে যায় যেমন পাকিস্তান, তেমনি ভারত। ভারতের হায়দরাবাদ শহরল রয়েছে মওলানা আজাদ ন্যাশনাল উর্দু বিশ্ববিদ্যালয়। তাছাড়া অন্ধ্র প্রদেশে রয়েছে ড. আবদুল হক উর্দু বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে আবদুল হক ভারত ত্যাগের আগে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন উর্দু কলেজ।

উন্নয়নের প্রায় সব সূচকে পাকিস্তান পিছিয়ে আছে বাংলাদেশের তুলনায়, কিন্তু ভাষা ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় সূচকে এগিয়ে। একইভাবে উন্নয়নের অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকলেও ভাষাভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় সূচকে এগিয়ে আছে ভারত। ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকা একটি জাতির ভাষা বিশ্ববিদ্যালয় সূচকে উর্দু ও হিন্দির তুলনায় পিছিয়ে থাকা অপ্রত্যাশিত। যদি এ দেশে ভাষাভিত্তিক একটি বিশ্ববিদ্যালয় থাকতো, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশকে এর উদ্ভাবকের মর্যাদা দেয়া যেতো।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সৈয়দ আলী আহসান, খান বাহাদুর আব্দুর রহমান খান, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ ও প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমদের স্বপ্ন ‘বাঙলা বিশ্ববিদ্যালয়’ কবে বাস্তবায়িত হবে?

লেখক: শিক্ষার্থী, সরকারি বাঙলা কলেজ, ঢাকা।

You might also like
Leave A Reply

Your email address will not be published.