দেশে নিম্ন আদালতে বেশির ভাগ রায় ও আদেশ দেওয়া হয় বাংলায়। এখন উচ্চ আদালতেও দিন দিন বাংলায় রায় ও আদেশ দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। অথচ এক দশক আগেও উচ্চ আদালতে বাংলায় দেওয়া রায় ও আদেশের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা।
১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন প্রবর্তন করা হয়। আইনটি পাস হওয়ার পর থেকেই সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের সব দাপ্তরিক আদেশ ও নির্দেশনা বাংলাতে হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত উচ্চ আদালতের কটি আদেশ ও রায় বাংলায় দেওয়া হয়েছে, সুনির্দিষ্টভাবে সে তথ্য জানা যায়নি।
বাংলা ভাষা প্রচলন আইনের (১)ধারা বলছে, ‘এই আইন প্রবর্তনের পর দেশের সর্বত্র, তথা সরকারি অফিস-আদালত, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া অন্যান্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে।’
আইনজীবী ও বিচারালয়-সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রয়াত বিচারপতি এ আর এম আমীরুল ইসলাম চৌধুরী নব্বইয়ের দশকের শুরুতে হাইকোর্টে বাংলায় আদেশ দেওয়া শুরু করেন। এরপর সাবেক বিচারপতিদের মধ্যে কাজী এবাদুল হক, হামিদুল হক, আবদুল কুদ্দুছ, সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক, আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী বেশ কয়েকটি রায় বাংলায় দেন।
এখন উচ্চ আদালতে রায় ও আদেশ বাংলায় দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে বলে জানান আইনজীবী ও বিচারালয়-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। হাইকোর্ট বিভাগের তিনজন বিচারপতি নিয়মিত বাংলায় রায় ও আদেশ দিয়ে থাকেন। একজন বিচারপতি কয়েক বছর ধরে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে বাংলায় রায় ও আদেশ দেন। এ ছাড়া ১০ থেকে ১৪ জন বিচারপতি বিভিন্ন সময়ে বাংলায় রায় ও আদেশ দিয়েছেন। গত বছর আপিল বিভাগ এক মামলায় বাংলায় রায় দেন।
এ প্রসঙ্গে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলায় রায় ও আদেশ লেখার ক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে একধরনের হীনম্মন্যতা কাজ করে। তবে ধীরে ধীরে মানসিকতার পরিবর্তন হচ্ছে। এখন অনেকেই বাংলায় রায় ও আদেশ দিচ্ছেন।’
ভবিষ্যতে সবাই বাংলায় রায় ও আদেশ দেবেন আশা প্রকাশ করে এ বি এম খায়রুল হক বলেন, ‘এ আশা থেকেই বিচারপতি থাকাকালে ২০০৭ সাল থেকে বাংলায় রায় দেওয়া শুরু করি। সদিচ্ছা থাকলে অধস্তন আদালতের মতো উচ্চ আদালতেও বাংলায় রায়-আদেশ লেখা সম্ভব।’
বাধা কাটাতে ‘আইন-শব্দকোষ’
বাংলায় রায় ও আদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে ইংরেজি শব্দের বাংলা পরিভাষার অপ্রতুলতা বড় অন্তরায় বলে মনে করেন আইন ও বিচারালয়-সংশ্লিষ্ট অনেকে। এ বাধা কাটাতে ইংরেজি সাড়ে চার হাজার শব্দের নতুন বাংলা পরিভাষাসহ প্রায় সাড়ে ১০ হাজার শব্দ নিয়ে আইনি পরিভাষার মৌলিক গ্রন্থ ‘আইন-শব্দকোষ’ এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেছে আইন কমিশন।
আইন-শব্দকোষ ২০০৬ সালে বাংলা ভাষায় প্রথম প্রকাশিত হয়। সাবেক প্রধান বিচারপতি ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রয়াত মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান এবং প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সম্পাদনায় প্রথম সংস্করণে ছয় হাজার পরিভাষা ছিল।
গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনসাধারণের জন্য বিচারকদের রায় বাংলায় লেখার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি ইংরেজিতে লেখা বিচারের রায় আসামিরা কতটুকু বোঝেন, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। এ ছাড়া ইংরেজিতে রায় লেখার সঙ্গে বাংলায় সেটির অনুবাদ যেন হয়, সেদিকে লক্ষ রাখার আহ্বান জানান তিনি।
এ লক্ষ্যে আলাদাভাবে অনুবাদক নিয়োগ ও তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ওপর প্রধানমন্ত্রী গুরুত্বারোপ করেন। আইন কমিশনের বের করা ‘শব্দকোষ’ এ ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে বলেও তিনি অভিমত দেন।
রায় অনুবাদে ‘আমার ভাষা’
সাধারণ মানুষ এবং বিচারপ্রার্থীরা যাতে রায় বুঝতে ও জানতে পারেন, সে লক্ষ্যে ইংরেজিতে দেওয়া রায় বাংলায় অনুবাদ করতে সুপ্রিম কোর্টে গত বছর নতুন একটি সফটওয়্যার যুক্ত হয়। ‘আমার ভাষা’ নামের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-সংবলিত এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে রায়গুলো বাংলায় অনুবাদ করা যায়।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশন সফটওয়্যারটি আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টকে দিয়েছে। এ সফটওয়্যারের মাধ্যমে ইংরেজি রায়ের ৭০ ভাগ সঠিক অনুবাদ হয়। বাকিটুকু নিজেদের ঠিক করে নিতে হয়।
ইতিমধ্যে, সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে বাংলায় অনুবাদ করা ১৩টি রায় প্রকাশ করা হয়েছে। এর মধ্যে আপিল বিভাগের দেওয়া চারটি ও হাইকোর্ট বিভাগের ৯টি রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য, দুই বিভাগের প্রায় ১০০টি রায় সফটওয়্যারের মাধ্যমে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে। অর্থগত পর্যালোচনা শেষে তা প্রকাশ করা হবে।
‘আমার ভাষা’ সফটওয়্যার ব্যবহার করে বাংলায় অনুবাদ করা রায়গুলো শিগগিরই সাধারণ মানুষের জন্য সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে বলে জানান সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র মোহাম্মদ সাইফুর রহমান। তিনি বলেন, অনুবাদের কাজে পাঁচজন কর্মকর্তা নিয়োজিত। তাঁদের ইতিমধ্যে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে।