The Rising Campus
Education, Scholarship, Job, Campus and Youth
বৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪

ফুটপাতে মিষ্টি বিক্রেতা বাবার এক ছেলে বিসিএস ক্যাডার, অন্যজন ডাক্তার মেয়েটাও সরকারি চাকুরে

রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানী পৌর বাজার। ফুটপাতে বাবার দোকানে বসে মিষ্টি বিক্রি করছেন দুই ছেলে। অমিত কুমার পাল বিসিএস ক্যাডার এবং মৃণাল কুমার পাল মিঠুন পেশায় ডাক্তার। ফেসবুকের কল্যাণে হয়তো অনেকেরই জানা। এই দুই ছেলেসহ তিন সন্তানকে মানুষ করতে গিয়ে স্বামী উত্তম কুমার পালের সঙ্গে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেছেন বাসনা রানী পাল।

বাসনা রানী পাল বলেন মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল আমার। শ্বশুরবাড়িতে এসে দেখি ছাপরা, ছনের বেড়া। বেশ বড় পরিবার। দাদি শাশুড়ি, নানি শাশুড়ি তো ছিলেনই, আরো ছিলেন দুই ননদ।

সংসারে অভাব অনটন লেগেই থাকত। দেড় কেজি চালে দুই বেলাও চলত না। খেয়ে না খেয়ে দিন পার করতে হয়েছে। বাতাসা, জিলাপি, লাড্ডু—এসব বিক্রি করা হতো। আমার স্বামী রুস্তমপুর, বাউসার হাটে যেতেন। বিভিন্ন মেলায় দোকান বসাতেন। রাতে ফিরতেন। বাড়িতে আমি ১০-১৫ কেজি চিনির সিরা তৈরি করতাম। লোকজন এসে দুধ দিয়ে যেত। সেই দুধ থেকে ছানা বানাতাম। এত বড় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হতো। মনে আছে, মাত্র দুটি মাত্র কাপড়ে বছর পার করেছি। ননদদের বিয়ে দিতে গিয়ে নিজের গয়না বিক্রি করেছি। একবার তো ঘরের টিনও বেচতে হয়েছিল। এর মধ্যে কোল আলো করে এলো মেয়ে। তার দুই বছর পর অমিত হলো। তিন বছর পর আরেক ছেলে হলো—মিঠুন।

এদিকে কাজ তো আর কমেনি। সকাল থেকেই কাজ। ওরা তো ছোট ছিল, বুঝত না। এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ির চেষ্টা করত। কোমরে দড়ি বেঁধে রাখতাম। এটা-সেটা কিনে দেওয়ার জন্য বায়না ধরত, কিন্তু সব সময় দিতে পারতাম না।

আমার ভাইয়েরা মাঝেমধ্যে দু-একটা খাতা কিনে আনত ছেলেমেয়েদের জন্য।

ওদের যে নতুন জামা-প্যান্ট কিনে দেব, সে অবস্থাও ছিল না। স্কুলে বা কোথাও বেড়াতে গেলে তখন শুধু জামা-প্যান্ট পরাতাম। বাড়িতে ছেলে দুটিকে ওদের বাবার ছেঁড়া লুঙ্গি পরিয়ে রাখতাম। বাটি মেপে ভাত দিতাম। একটা ডিম ভেজে পাঁচ টুকরা করে সবাই মিলে খেতাম।

ঝড় এলে এখনো খুব ভয় লাগে আমার। একবারের ঘটনা খুব মনে পড়ছে। সেদিন আকাশটা যেন ভেঙে পড়ছিল। গভীর রাত। প্রচণ্ড ঝড়ে ঘরের চালার টিন উড়ে চলে গেল। অত রাতে কোথাও যে যাব, সে সুযোগও ছিল না। অনন্যোপায় হয়ে রাতভর ছেলেমেয়েদের নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম!

ননদরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের ব্যবহার করা কাপড় দিতেন আমার ছেলেমেয়েদের পরার জন্য। এসবের মধ্যেই বড় মেয়ে ম্যাট্রিক পাস করল। কিছুদিন পর অমিতও ম্যাট্রিক পাস করল। ও চাইছিল নিউ ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হতে, কিন্তু টাকার অভাবে ভর্তি করাতে পারিনি। শেষে ভর্তি হলো আড়ানী কলেজে। সেই কলেজ থেকে এ প্লাস পেল। অমিত জানাল, সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চায়। ভর্তি পরীক্ষার জন্য কোচিং করা লাগবে। তখন ঋণ করে ছেলেটাকে কোচিং সেন্টারে ভর্তি করলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেল সে।

মেয়েটা শহরের একটা কলেজে পড়ত। মেসে থাকত, কিন্তু একসময় আর চালাতে পারছি না দেখে বাসায় চলে এলো সে। টাকার অভাবে ওকে নতুন বই কিনে দিতে পারিনি। বন্ধুদের কাছ থেকে বই নিয়ে ফটোকপি করে পড়ত।

তখন ছেলেমেয়ে তিনজনই ওপরের ক্লাসে পড়ে। মাস শেষে ওদের টাকা লাগে, কিন্তু অত টাকা দেওয়ার সাধ্য তো আমার নেই।

হাটে আমার স্বামী দোকান দিতে পারেননি অনেক দিন। মালপত্র কম ছিল বলে দোকানে বেচাকেনাও তেমন একটা হতো না। ধারদেনা হয়ে গিয়েছিল অনেক। মানুষকে আর কত দিন বলে-কয়ে রাখা যায়। একসময় পাওনাদারের ভয়ে বাড়ি থেকে দূরে সরে থাকতাম। ফলে কেউ সহজে ধার দিতে চাইত না।

তখন কাগজের ঠোঙা বানিয়ে সংসার চালিয়েছি। ছেলেমেয়েরাতো পড়াশোনার জন্য বাইরে থাকত। বাড়িতে ওদের বাবা আর আমি এক বেলা খেয়ে দিনপার করেছি, কিন্তু ওদের এসব কখনো বুঝতে দিতাম না। একসময় বাধ্য হয়ে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছিলাম, কিন্তু কিস্তি চালাতে হিমশিম খেতে হতো। প্রায়ই সমিতির লোকজন এসে অপমান করতো। এভাবে চলতে চলতে শুনলাম বড় ছেলেটা বিসিএস পরীক্ষা দিচ্ছে। বিসিএস-টিসিএস অত কিছু বুঝি না আমি। এরই মধ্যে একদিন ঢাকা থেকে ফোন করল অমিত। বলল, ‘মা আমার বিসিএস হয়ে গেছে। আমি সরকারি চাকরি পেয়ে গেছি। ’ কয়েক দিন আগে মেয়েটারও চাকরি হলো এসেনশিয়াল ড্রাগসে। ছোট ছেলেটাও এমবিবিএস পাস করল। ছেলেমেয়েরা নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। এটা দেখে মরে গেলেও শান্তি লাগবে।

এখন পর্যন্ত বাড়িতে ঠিকঠাক ঘর বানাতে পারিনি। কিছু মহাজনী ঋণ ছিল, সেগুলো শোধ করতে হচ্ছে। তবে ভালো লাগে যখন মানুষ এসে বলে, ‘তোমার এক ছেলে বিসিএস ক্যাডার, অন্যজন ডাক্তার, মেয়েটাও সরকারি চাকরি করছে—আর কী লাগে। ’ মা হিসেবে এটাই তো আমার বড় পাওয়া।

ছেলেমেয়েদের কখনো ভালো পোশাক, খাবার কিংবা ঘুমানোর জন্য ভালো জায়গা দিতে পারিনি। আজ ওরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। ওদের নিয়ে আমরা খুবই গর্বিত।

অমিত কুমার পাল ও মৃণাল কুমার পাল মিঠুন দুই ভাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন অমিত। ৩৫তম বিসিএসের মাধ্যমে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন সান্তাহার সরকারি কলেজে। তিনি বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার চার মাস মেয়াদি ১৬৪তম বনিয়াদি প্রশিক্ষণে প্রথম হয়ে ‘চেয়ারম্যান অ্যাওয়ার্ড’ অর্জন করেন। অন্যদিকে রংপুর প্রাইম মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন মৃণাল কুমার পাল। একমাত্র বোন মিতা রানী পাল পড়ালেখা শেষ করে সম্প্রতি সরকারি এসেনশিয়াল ড্রাগস কম্পানিতে জুনিয়র অফিসার পদে যোগদান করেছেন।

You might also like
Leave A Reply

Your email address will not be published.