The Rising Campus
Education, Scholarship, Job, Campus and Youth
রবিবার, ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪

ফিলিস্তিনের মুক্তি: আমাদের নৈতিক দায়িত্ব ও করণীয়

জুনায়েদ মাসুদঃ ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন সংকট নিছক একটি আঞ্চলিক সংঘাত নয় বরং এটি মানবিকতার বিরুদ্ধে চলমান একটি যুদ্ধ। প্রায় এক শতাব্দী ধরে চলে আসা এই সংঘাতের পটভূমিতে রয়েছে ভূমি দখল, ধর্মীয় বিরোধ, এবং রাজনৈতিক আধিপত্যের লড়াই। বর্তমান পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনিরা যে নির্মম গণহত্যার শিকার, তা আন্তর্জাতিক মহলে আলোচিত হলেও কার্যকর পদক্ষেপের অভাব আজও চরম হতাশাজনক।

জায়োনিস্ট আগ্রাসন এবং ফিলিস্তিনের বর্তমান:

ফিলিস্তিনে আজ যা ঘটছে, তা শুধু দখলদারিত্ব নয়, বরং একটি পরিকল্পিত গণহত্যা। ইসরায়েল তাদের সামরিক শক্তি ও মিডিয়া প্রভাব ব্যবহার করে নিজেদের পক্ষে বিভ্রান্তিকর ন্যারেটিভ তৈরি করছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই ঘটনাগুলোকে তারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করছে।

বিশ্বের অনেক দেশ ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান নিলেও তাদের পদক্ষেপগুলো বেশিরভাগ সময় প্রতীকীই থেকে গেছে। জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ। ইসরায়েলের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত প্রভাব বিশ্ব রাজনীতিতে এতটাই গভীর যে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমাদের করণীয়: একক ও সম্মিলিত উদ্যোগ
ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্য আমাদের করণীয় কাজগুলোকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়।

১. স্বল্পমেয়াদী উদ্যোগ:
ইসরায়েলি পণ্য বর্জন: ইসরায়েলি পণ্য বর্জন তাদের অর্থনীতিতে সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইতিমধ্যে এই ধরনের বর্জন আন্দোলন চলছে, যা আমাদেরও অংশগ্রহণের দাবি রাখে।

সচেতনতা বৃদ্ধি: অনলাইন এবং অফলাইনে ফিলিস্তিনের উপর চলমান নির্যাতনের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে হবে। সংবাদ, ছবি, এবং ভিডিওর মাধ্যমে মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে।

বিকল্প ন্যারেটিভ তৈরি: জায়োনিস্টদের বিভ্রান্তিকর প্রচারণার বিপরীতে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে শক্তিশালী ন্যারেটিভ দাঁড় করানো জরুরি।

মিডিয়া ক্যাম্পেইন: সোশ্যাল মিডিয়ায় তথ্য-উপাত্ত সমৃদ্ধ ক্যাম্পেইন চালিয়ে ফিলিস্তিনের সত্যিকারের চিত্র তুলে ধরা প্রয়োজন।

মানবিক সাহায্য: ফিলিস্তিনিদের জন্য ত্রাণ ও অর্থনৈতিক সাহায্য জোগাড় করতে হবে। যারা সেখানে সরাসরি সাহায্য পৌঁছে দিতে পারেন, তাদের মাধ্যমে খাদ্য, চিকিৎসা, ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

পাবলিক অ্যাডভোকেসি: স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জনমত গঠন করতে হবে। মানববন্ধন, মিছিল, সেমিনার, এবং প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এ বিষয়ে আলোচনা বাড়ানো যেতে পারে।

২. দীর্ঘমেয়াদী উদ্যোগ:
শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চা: মুসলিম বিশ্বকে জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্প এবং অর্থনীতিতে শক্ত অবস্থান তৈরি করতে হবে। পাশ্চাত্যনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তে এমন একটি কাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যা মুসলিম সভ্যতার ঐতিহ্য এবং আধুনিক জ্ঞানের সমন্বয়ে নির্মিত।

অর্থনৈতিক আত্মনির্ভরশীলতা: ইসরায়েলের মতো শক্তিশালী দেশগুলোকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য মুসলিম দেশগুলোকে নিজেদের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করতে হবে।

রাজনৈতিক ঐক্য: মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বে ঐক্যের ঘাটতি রয়েছে। এই বিভাজন দূর করে একটি সম্মিলিত অবস্থান গ্রহণ করতে হবে।

তথ্যপ্রযুক্তি এবং সাইবার শক্তি: প্রযুক্তির যুগে মুসলিম সমাজকে সাইবার নিরাপত্তা এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। জায়োনিস্ট প্রচারণার বিরুদ্ধে সাইবার শক্তি ব্যবহার করে তথ্য যুদ্ধ চালানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবন: ফিলিস্তিনসহ গোটা মুসলিম বিশ্বের সংস্কৃতিকে পুনর্জাগরিত করতে হবে। সাহিত্য, শিল্প, এবং সংস্কৃতির মাধ্যমে ন্যায়বিচারের জন্য একটি জাগ্রত জনমত তৈরি করা সম্ভব।

৩. আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে অবস্থান:
কূটনৈতিক তৎপরতা: জাতিসংঘ, ওআইসি, এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে ইসরায়েলের অন্যায় কাজগুলোর বিরুদ্ধে কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করতে হবে।

বয়কট আন্দোলন সম্প্রসারণ: শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে নয়, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসরায়েলি পণ্য ও সার্ভিস বয়কটের জন্য জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে।

আইনগত পদক্ষেপ: ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করা এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ের চাপ সৃষ্টি করতে হবে।

ঐক্য এবং ধৈর্যের গুরুত্ব:
ফিলিস্তিনের মুক্তি তাৎক্ষণিকভাবে অর্জন সম্ভব নয়। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী সংগ্রাম, যেখানে আমাদের প্রয়োজন ধৈর্য, ঐক্য এবং সুসংগঠিত পরিকল্পনা। মুসলিম বিশ্বে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব এবং বিভাজনমূলক মনোভাব এ আন্দোলনের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। তাই ফিলিস্তিনের মুক্তি নিশ্চিত করতে হলে মুসলিম বিশ্বের একতা এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

ফিলিস্তিনের জন্য লড়াই শুধু তাদের ভূমির লড়াই নয়; এটি মানবিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লড়াই। ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা গোটা মুসলিম বিশ্বের নৈতিক দায়িত্ব এবং এটি আমাদের ঐতিহ্য, বিশ্বাস, ও মানবতার প্রতি দায়বদ্ধতার অংশ। ব্যক্তি এবং সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা যদি এই লড়াইকে এগিয়ে নিতে পারি, তবে একদিন ফিলিস্তিন স্বাধীন হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

You might also like
Leave A Reply

Your email address will not be published.