বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি জীবন্ত ইতিহাস। দেশের স্বাধীনতা সহ প্রত্যেকটি বড় অর্জনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জড়িয়ে আছে অতপ্রত ভাবে। ইতিহাসের এক ধারাবাহীক অধ্যায়ের নাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠানের আনাচকানাচে ছড়িয়ে আছে শত-শত ইতিহাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইট-পথরও স্বাক্ষী হয়েছে ইতিহাসের নান অধ্যায়ে। বটতলা, মধুর ক্যানটিন, কলাভবন, শহীদ মিনার এমন কোনো জায়গা নেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের, যেখানে বাঙালি ও বাংলাদেশের ইতিহাস তার কোনো নতুন পর্ব উন্মোচন করেনি। দেশ ও জাতীর প্রয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বাগ্রে থেকেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রাণ পুরুষ ছিলেন ঢাকার চতুর্থ নবাব, ব্রিটিশ রাজত্বের সময়কার উপমহাদেশের অন্যতম রাজনীতিবিদ, পূর্ব বাংলার শিক্ষা বিস্তারের অগ্রদূত স্যার খাজা সলিমুল্লাহ। তার অগ্রনী ভূমিকার কারনে পূর্ববঙ্গের মানুষ পায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব স্যার সলিমুল্লাহ ঢাকাতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি মূলত ১৯১১ সালেই এক রাজনৈতিক সমাবেশে উত্থাপন করেছিলেন। স্যার সলিমুল্লাহর দান করা ৬০০ একর জমিতেই ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
১৯২১ সালের জুলাই মাসে ৩টি অনুষদের অধীনে (বিজ্ঞান, কলা ও আইন) ১২টি বিভাগ ও ৮৪৭ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে।
প্রতিষ্ঠলগ্নে আবাসিক পরিবেশঃ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে শুরু থেকেই সুপরিকল্পিত ভাবে একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলা হয়। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল তিনটি হল নিয়ে। ঢাকা হল (পরবর্তীতে শহীদুল্লাহ হল), জগন্নাথ হল এবং মুসলিম হল (পরবর্তীতে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল)। হলগুলো শুধু ছাত্রাবাস হিসেবে নয় বরং তা ছাত্রদের শিক্ষা, সমাজ ও সাংস্কৃতিক জীবনে উপযুক্তভাবে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা ও অনুশীলন কেন্দ্ররূপে গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনায় ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষক কোন না কোন হলের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন, ছাত্রদের উপদেষ্টারুপে এবং অনুশীলনী ক্লাস নিবেন। প্রত্যেকটি হলকে চারটি হাউসে বিভক্ত করা হয়েছিল চারশত ছাত্রের জন্য আর প্রতি পঁচাত্তরজন ছাত্রের তত্ত্ববধানের জন্য একজন করে আবাসিক শিক্ষক বা হাউস টিউটরের ব্যবস্থা ছিল।
ঢাকা হলঃ
ঢাকা হলের প্রথম প্রভোস্ট ছিলেন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ এফ. সি. সি. টার্নার। শুরুতে একমাত্র ঢাকা হলেরই নিজস্ব ভবনে ছিল; কার্জন হল মিলনায়তনটি তার অধিকারভুক্ত ছিল সে কারণে একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের শিক্ষা বহির্ভূত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে ঢাকা হল ছাত্র সংসদের ভূমিকা ছিল অগ্রগন্য। দেশ বিভাগের পর ঢাকা হলই ছিল প্রগতিশীল বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের সূতিকাগার, ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন মহান গণঅভ্যুত্থানে পরিনত হয়েছিল ঢাকা হলের প্রগতিশীল ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামানের শাহাদাতের বিনিময়ে।
আরও পড়ুন: বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষায় প্রস্তুতি, আত্মবিশ্বাস ও পরিবারের উৎসাহ
মুসলিম হলঃ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু মুসলিম ছাত্রদের জন্য স্থাপিত প্রথম হল “সলিমুল্লাহ মুসলিম হল” এ হলের প্রথম প্রোভস্ট নিযুক্ত হন ইতিহাস বিভাগের রিডার স্যার এ এফ রাহমান। ১৯২৯ সালের ২২ আগস্ট বাংলার গভর্ণর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসন ঢাকার প্রয়াত নবাব বাহাদুর স্যার সলিমুল্লাহ্র নামানুসারে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের’ এর ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন করেন। ১৯৩১-৩২ শিক্ষাবর্ষে এর ভবন নির্মাণের কাজ শেষ হয়।
জগন্নাথ হলঃ
জগন্নাথ হলের নামকরণ হয় ঢাকার বলিয়াদির জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরীর দানে তার পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামে। জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামেই ঢাকার জগন্নাথ কলেজের নামকরণ করা হয়েছিল। জগন্নাথ হলের প্রথম প্রভোস্ট ছিলের আইন বিভাগের প্রথম অধ্যাপক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত। অধ্যাপক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের উৎসাহে জগন্নাথ হলের প্রথম বার্ষিক সাহিত্যপত্র ‘বাসন্তিকা’ ১৯২৩ সালের প্রথম প্রকাশিত হয়। নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের পর প্রভোস্ট হন ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার।
ছাত্রী হোস্টেল ‘চামেরি হাউস’
কলকাতা বেথুন কলেজের গ্রাজুয়েট লীলা নাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী শিক্ষার্থী। ১৯২১ সালে লীলা নাগ ইংরেজিতে এমএ ক্লাসে ভর্তি হন এবং ১৯২৩ সালের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এমএ ডিগ্রিধারী হিসেবে বের হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ছাত্রী সুষমা সেনগুপ্তা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্রী ছিলেন গণিত বিভাগের ফজিলতুন্নেসা।
যত সময় যেতে থাকে ধীরে ধীরে ছাত্রীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকে তখন ছাত্রীদের জন্য আলাদা আবাসনের দেখা দেয়। এই উদ্দেশে ১৯২৬ সালের ২৮ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭ নং বাংলো ‘চামেরি হাউস’-এ (বর্তমানে সিরডাপ ভবন) প্রথম উইমেনস হাউস প্রতিষ্ঠা করা হয়। উইমেনস হাউস মাত্র তিন জন ছাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করে। মিসেস পি. নাগ এই হাউসের হাউস টিউটর নিযুক্ত হন।
‘চামেরি হাউস’ ১৯৩৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের হল হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছিল, ১৯৫৭ সালে রোকেয়া হল নির্মাণের আগ পর্যন্ত এটা ছাত্রী নিবাসই ছিল।