মো: আতিকুর রহমান: বিগত ৫ আগস্ট ঐতিহাসিক ছাত্র-জনতার অভ্যূত্থানের ফলে দেশের বুক থেকে দীর্ঘ দেড় দশকের স্বৈরশাসনের জগদ্দল পাথর নেমে যাওয়ায় দেশ ফ্যাসিবাদ মুক্ত হয়েছে, মুক্ত হয়েছে দেশের আপামর জনসাধারণ। এর ফলে মুক্তভাবে দেশের মানুষ নিশ্বাস নিতে পারছে। দীর্ঘদিন মানুষের সংবিধান স্বীকৃত অধিকার ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা’ ছিল না, ছিল না মত প্রকাশের স্বাধীনতা। অত্যাচার-নির্যাতনের খড়গ চাপিয়ে যে কোন পন্থায় ভিন্নমত দমনে যেভাবে জঘন্নতম স্টিমরুলার চালানো হয়েছে মানবসভ্যতার ইতিহাসে তা নজিরবিহীন-একথা বলাই বাহুল্য। তাই ৫ আগস্টের গণঅভ্যূত্থানের পর সকল শ্রেণি পেশার মানুষের মনে আশার সঞ্চার হয়েছে যে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা চর্চার পাশাপাশি ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা ভোগ করবে আপামর জনসাধারণ।
মানুষের মত প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম ও প্লাটফরম হচ্ছে নিজ নিজ আদর্শের রাজনৈতিক সংগঠন। সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ, ১৯৪৮ এর ধারা ১৮, ও ১৯ দ্বারা যে কোন ভূখন্ডের যে কোন নাগরিকের ধর্ম, বিবেক ও চিন্তার স্বাধীনতা, মতামত পোষণ এবং মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার প্রদান করা হয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রের বিশেষ একটি পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র পরিচালনার ভার গ্রহণ করে শপথ নিয়েছে এবং অদ্যবধি বিদ্যমান সংবিধানকেই বহাল রেখেছে। যদিও দেশের সংবিধান পরিবর্তন করে একটি জনমুখী ও জনহিতকর সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ‘সংবিধান সংস্কার কমিশন’ গঠন করেছে। তর্কের খাতিরে যদিও ধরেও নেই যে, নতুন সংবিধান দ্বারা বিদ্যমান সংবিধানের সকল কিছুর আমূল পরিবর্তন করা হবে, তথাপিও নতুন সংবিধান প্রণীত ও গৃহীত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বিদ্যমান সংবিধানের আলোকেই দেশের সকল নাগরিক তাদের অধিকার ভোগ করবে। বিদ্যমান সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বর্ণিত মৌলিক অধিকারসমূহ যে কোন বিবেচনায় সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৭, ৩৮, ৩৯ অনুচ্ছেদ দ্বারা শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হওয়ার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করার, রাজনৈতিক সংগঠন করার, রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করার এবং চিন্তা ও ভাব প্রকাশের তথা মত প্রকাশের স্বাধীনতা ভোগের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। যা সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ, ১৯৪৮ এর ধারা ১৮, ও ১৯ এর সমতূল। সংবিধানের ৩৭, ৩৮, ৩৯ অনুচ্ছেদ দ্বারা নিশ্চিতকৃত অধিকার শুধু জরুরী অবস্থার বিধানাবলী সাপেক্ষেই সীমাবদ্ধ থাকে।
৫ আগস্ট ঐতিহাসিক ছাত্র-জনতার অভ্যূত্থানের মাধ্যমে বিশ্ব বরেণ্য অর্থনীতিবিদ নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ পরিচলানার দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশের রাজনৈতিক পরিমন্ডলে যে সুশৃঙ্খল আবহ বইছে- কোন এক অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে সেই সুবাতাস হতে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদেরকে বঞ্চিত করার পায়তারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দেশের সর্বত্র রাজনৈতিক কর্মকান্ড চলমান থাকলেও সময়ের স্রোতে গাঁ ভাসিয়ে, মব জাস্টিসের ন্যায় সময়ের ট্রেন্ড বা কালের প্রবণতা অনুসরণ করে অহেতুক কতিপয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি স্থগিত করা হয়েছে, কোথাও কোথাও অতি উৎসাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কর্তৃক ছাত্র রাজনীতি স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাহলে এ প্রশ্ন রাখা কি অবান্তর হবে যে, ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর জনমনে স্বাধীনভাবে মত ও দ্বীমত প্রকাশের যে আশার সঞ্চার হয়েছিল, তা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদেরকে বাহিরে রাখা হয়েছিল? নাকি দেশের সর্বত্র স্বাভাবিক পরিবেশ থাকলেও শুধু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস গুলোতে জরুরী অবস্থা চলছে- যার কারণে শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক অধিকার স্থগিত করা হয়েছে? যদি তা না হয়ে থাকে তাহলে দেশ জুড়ে যখন রাজনৈতিক কর্মকান্ড চলে, তখন শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি নাই কেন? যে সময়ে দেশের বিভিন্ন সেক্টরে সুশাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নানাবিধ সংস্কার কার্যক্রমের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, গঠন করা হয়েছে ৬ টি ভিন্ন ভিন্ন সংস্কার কমিশন, সে সময় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র রাজনীতির সংস্কারের উদ্যোগ না নিয়ে বরং রাজনীতি স্থগিত বা নিষিদ্ধ করা হয়েছে-যা বিরাজনীতিকরণেরই ভিন্নরূপ।
মনে রাখতে হবে বর্তমান সমাজের নাগরিকগণের চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা কোন নির্দিষ্ট দেশের পরিগন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং গণযোগাযোগ মাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে এ সমাজের নাগরিকগণের চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা বিশ্বময় পরিব্যপ্ত। এ কারণেই বর্তমান শিক্ষিত সমাজের নাগরিকগণকে বিশ্বনাগরিক বলে মনে করা হয়। ৩৬ শে জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে মাধ্যমে যে ফ্যাসিবাদ মুক্ত গণতান্ত্রিক, মেধা ভিত্তিক, আধুনিক ও নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নের বীজ বপন করা হয়েছে, সকল মতের মানুষের ন্যায়ানুগ মত প্রকাশের স্বাধীনতা লাভের যে প্রত্যাশা সৃষ্টি করা হয়েছে- যে কোন প্রকার বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়া সে স্বপ্ন ও প্রত্যাশা পূরণের পথে নির্ঘাত প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে।
গণতান্ত্রিক, মেধা ভিত্তিক আধুনিক ও নতুন বাংলাদেশ, মত প্রকাশের স্বাধীনতার বাংলাদেশ গঠন করতে হলে দেশের তরুণ ও ছাত্র সমাজকে সুষ্ঠু ধারার-গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত করে মননশীল, মেধা ভিত্তিক নতুর রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরি করতে হবে। কারণ এই শিক্ষিত ও মেধাবী তরুণরাই অনাগত দিনে দেশের ভবিষ্যত রাজনীতি সহ দেশের সর্বক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তাই যে কোন প্রকার বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা প্রদর্শন আবশ্যক। সিদ্ধান্তের সুদূর প্রসারী প্রভাবের দিকটাও আবশ্যিকভাবে বিবেচনায় নিতে হবে ।
লেখক: শিক্ষার্থী মাস্টার্স ১ম সেমিস্টার, ইনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স, বাকৃবি এবং আহবায়ক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল।