প্রকৃতিতে শরতের শুভ্রতার সঙ্গে আসছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। শিশির ভেজা ভোর আর শরতের কাশফুল জানান দিচ্ছে শারদীয় দুর্গোৎসবের আগমনী বার্তা। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের জন্যই দেবী দুর্গার স্বর্গ থেকে আগমন ঘটেছিল মর্ত্যলোকে। এরই ধারাহিকতায় হিন্দুধর্মাবলম্বীরা প্রতি বছর শারদীয় উৎসব হিসেবে দুর্গাপূজা উদযাপন করে আসছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজাকে ঘিরে রাজধানীর পুরান ঢাকায় চলছে সাজ সাজ রব। এরই মাঝে এখানকার মন্ডপগুলোর প্রতিমা তৈরিতে কারিগরেরা ব্যস্ত সময় পার করছেন।
দুর্গোৎসবের প্রধান অনুষঙ্গ হলো দেবী দুর্গার প্রতিমা। উৎসব সামনে রেখে প্রতিমা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন মৃৎশিল্পীরা। মৃৎশিল্পীদের নিপূণ হাতের ছোঁয়ায় মাটির মূর্তি গুলো হয়ে উঠছে অপরূপ। খড় আর কাদা মাটি দিয়ে প্রতিমা তৈরি শেষে এখন চলছে মূর্তির উপর প্রলেব ও রঙ্গের কাজ। একই সাথে শরতের দুর্গোৎসবকে পরিপূর্ণভাবে সাজাতে দিনরাত মন্দির গুলোতে চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি। পূজা শুরুর আগেই মা দুর্গাকে তুলতে হবে মণ্ডপে। ইতোমধ্যে প্রতিমার কাঠামোর মাটির কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এরপর শুরু হবে রং ও সাজসজ্জার কাজ।
পুরান ঢাকার বেশ কয়েকটি পূজামন্ডপ ঘুরে দেখা গেছে, কাদা-মাটি, বাঁশ, খড়, সুতলি দিয়ে শৈল্পিক ছোঁয়ায় তিলতিল করে গড়ে তোলা হচ্ছে দেবীদুর্গার প্রতিমা। কারিগররা প্রতিমা তৈরিতে দিনরাত ব্যস্ত সময় পার করছেন। দম ফেলার সময় নেই কারিগরদের। সুনিপুণ হাতে মাটি ও রং তুলির ছোঁয়ায় দেবীকে রাঙিয়ে তুলতে ব্যস্ত শিল্পীরা। প্রতিটি পূজা মণ্ডপে প্রতিমা বানানোর কাজ শেষ। এখন রঙ তুলির আঁচড়ে সাজানো হচ্ছে এসব মূর্তি। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কেউ কাঁদা তৈরি করছেন, কেউ কাঁদা থেকে হাত-পা বানাচ্ছেন, আবার কেউ ব্যস্ত রং করায়। প্রতিমা শিল্পীদের সঙ্গে ব্যস্ত সময় পার করছেন তাদের কারিগররাও।
ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত প্রতিমার কারিগররা ব্যস্ত সময় পার করছেন। নিখুঁতভাবে মনের মাধুরি মিশিয়ে তারা প্রতিমা তৈরির কাজ করছেন। ব্যস্ততায় যেন দম ফেলার ফুরসত নেই প্রতিমা শিল্পীদের। নিপুন হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হচ্ছে দেবী দূর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, অসুরসহ বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি। দেবী দুর্গা ও তার বাহন সিংহের প্রতিমাসহ তৈরি করা হচ্ছে যাকে বধের জন্য দেবীর আগমন সেই মহিষাসুরের প্রতিমা। এছাড়াও তৈরি হচ্ছে দেবী লক্ষ্মী, সরস্বতী, দেবতা কার্তিক, গণেশ, এবং তাদের বাহন পেঁচা, হাঁস, ইঁদুর আর ময়ূর। এমনটাই প্রতিমা তৈরির মাঠ গুলো ঘুরে লক্ষ্য যায়।
এদিকে বাংলাবাজারের নর্থব্রুক হল রোডের জমিদার বাড়িতে দুর্গার বাহকসহ প্রতিমার শাড়ি ও অলংকার পরানোর কাজও ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে। আলোকসজ্জা ও রঙিন কাগজ দিয়ে সাজান হচ্ছে প্রতিটি মণ্ডপ। প্রতিমা দেখতে এখনই দর্শনার্থীরা মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
বাঙালি হিন্দুর উৎসবের ঢাকে কাঠি পড়া শুরু হয় ষষ্ঠীর আগে থেকেই। এবারের দুর্গাপূজা ১ অক্টোবর (১৪ই আশ্বিন) ষষ্ঠী পূজা দিয়ে শুরু করে ৫ অক্টোবর (১৮ই আশ্বিন) বিজয়া দশমী দিয়ে শেষ হবে। এর আগে পঞ্চমী থেকেই শুরু হয়ে যায় উৎসবের আমেজ। তবে ষষ্ঠী থেকেই কার্যত উৎসবের ঢাকে কাঠি পড়া শুরু হয়। শাস্ত্রমতে দুর্গাপুজোর মহাষষ্ঠীর দিন বোধন হয়।
রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি পূজা উদযাপিত হয় পুরান ঢাকায়। এবার শাঁখারিবাজার, তাঁতীবাজার, লক্ষ্মীবাজার, সূত্রাপুর, শ্যামবাজার, প্যারীদাস রোড, কলতাবাজার, মুরগিটোলা, মদনমোহন দাস লেন, বাংলাবাজার গোয়ারনগর, জমিদারবাড়ী, গেণ্ডারিয়া, ডালপট্টি এলাকার অলিগলিতে পূজার আয়োজন করা হবে। ছোট-বড় বিভিন্ন মণ্ডপে শুরু হয়েছে মঞ্চ, প্যান্ডেল, তোরণ ও প্রতিমা নির্মাণের কাজ। এ বছর পুরান ঢাকায় নবকল্লোল পূজা কমিটি, শ্রীশ্রী শিব মন্দির, প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব, সংঘমিত্র পূজা কমিটি, শ্রীশ্রী রাধা মাধব জিউ দেব মন্দির, নতুন কুঁড়ি পূজা কমিটি, নববাণী পূজা কমিটি, রমাকান্ত নন্দীলেন পূজা কমিটিসহ আরও বেশ কিছু ক্লাব পূজা আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে। তবে শিবমন্দীর, তাঁতী বাজার, সঙ্গ মিত্র, প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব, গোয়ালনগর ঘাট, জুলন বাড়ীতে বড় পূজার আয়োজন করা হচ্ছে।
কারিগররা সাধারণত অজন্তা ধাঁচের মূর্তি বানিয়ে থাকেন। এগুলো ওরিয়েন্টাল প্রতিমা হিসেবে পরিচিত। অজন্তা ধাঁচের মূর্তির চাহিদা এখন বেশি। এ ধরনের মূর্তিতে শাড়ি, অলংকার ও অঙ্গসজ্জা সবই করা হয় মাটি ও রঙ দিয়ে। প্রতিমার শাড়ি, অলংকার, সাজসজ্জার উপকরণ আলাদাভাবে কিনে নিতে হয়।
মৃৎশিল্পীরা জানান, প্রতিবছরই তারা অধীর আগ্রহে দেবী দুর্গার প্রতিমা তৈরির কাজের অপেক্ষায় থাকেন। শুধুমাত্র জীবিকার জন্যই নয়। দেবী দুর্গার প্রতিমা তৈরির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে তাদের ধর্মীয় অনুভূতি, ভক্তি আর ভালোবাসা। দুর্গা মাকে মায়ের মতোই তৈরি করা হচ্ছে।
শাঁখারিবাজারের সংঘমিত্র পূজা কমিটির মণ্ডপে দেবী দুর্গার প্রতিমা তৈরি করছেন মানিকগঞ্জের সুকুমার পাল। এবারের দুর্গোৎসবে এখানকার ছয়টি প্রতিমা সহ বনানীতে আরও ছয়টি বানাচ্ছেন তিনি।
সুকুমার পাল জানান, সর্বনিম্ন ৫০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ চার লাখ টাকায় এসব প্রতিমা বানানো হচ্ছে।
বাংলা বাজারে জমিদার বাড়িতে পূজামণ্ডপের প্রতিমায় রঙ দেয়ায় ব্যস্ত মৃৎ শিল্পী বলাই পাল।
তিনি বলেন, ‘এখনই বছরের সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত সময় পার করছি। পূজার আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি। তাই দম ফেলার সময়ও নেই। এর মধ্যেই দেবী দুর্গার প্রতিমা তৈরির সব কাজ শেষ করতে হবে।’
কাজ শেষে বিশ্রামের ফাঁকে প্রতিমা শিল্পী পল্টন পাল বলেন, ‘যত কষ্টই করি না কেন, যখন দেবীকে তার স্বরূপে মণ্ডপে বসানো হবে তখন সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে। আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে যখন আমাদের তৈরি প্রতিমাকে সবাই পূজা করে। তখন নিজেকে আমার সফল, সার্থক মনে হয়।’
শাঁখারি বাজারের প্রতিমা শিল্পী সুশীল নন্দী গত হওয়ায় এবার এ মন্ডপের প্রতিমা তৈরির দায়িত্ব নিয়েছেন তার মেয়ে অনামিকা নন্দী।
তিনি বলেন, জন্মের পর থেকেই বাবার কাছে এই কাজ দেখে ও শিখে আসছি। প্রাথমিকভাবে খড়, কাঠ, বাঁশ, সুতা, তারকাটার প্রয়োজন হয়। মূর্তি শুকানোর পর রঙ করা হয়।
এদিকে জগন্নাথ এপার্টমেন্টে বেশ কয়েকটি প্রতিমা তৈরিতে ব্যস্ত ধষরত পাল। তিনি জানান, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, পাটুরিয়া, সাভার সহ বেশ কিছু জায়গা থেকে মাটি আনা হয়। আর সব জায়গার মাটি দিয়ে মায়ের প্রতিমা তৈরি করা হয়।
প্রতিমা তৈরির কারিগর নিশি পাল জানান, খড় আর কাঁদামাটি দিয়ে প্রতিমা তৈরির প্রাথমিক কাজ প্রায় শেষের দিকে। এখন রঙ আর তুলির আঁচড় দিয়ে দুর্গাকে সাজানো হবে। এদিকে প্রতিমা তৈরির উপকরণের দাম বাড়ছে প্রতি বছরই। তবে শুধুমাত্র পারিশ্রমিক নয় মায়ের ভক্তি পেতেই তাকে প্রকৃত রূপে ফুটিয়ে তুলতে পরিশ্রম করে তার শক্তিতে কাজ করে যাচ্ছেন তারা।
দুর্গাপূজার আয়োজন নিয়ে শিব মন্দীর পূজা কমিটির কোষাধ্যক্ষ দেবব্রত ঘোষ গগণ বলেন, পূজায় সর্বস্তরের মানুষের সমাগম ঘটবে। এটা যেমনি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। তেমনি এতে অন্য ধর্মের বিপুল সংখ্যক মানুষ অংশগ্রহণ করে। তাই সবার কথা মাথায় রেখে সব ধরনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
প্রসঙ্গত, ইউনেস্কোর তালিকায় স্থান পেয়েছে বাঙালির প্রধান উৎসব দুর্গাপুজো। ইউনেস্কোর ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে দুর্গাপুজোকে। ফ্রান্স, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, ব্রাজিল, বলিভিয়ার মতো বিশ্বের মাত্র ৬ দেশের উৎসব এখনও পর্যন্ত ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে। এবার সেই তালিকায় যোগ হয়েছে দুর্গাপূজা।