এমরান হোসেন, পাবিপ্রবি: শহীদ মিনারে ফুল দেওয়াকে কেন্দ্র করে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (পাবিপ্রবি) কর্মকর্তাদের দুটি সংগঠন অফিসার্স এ্যাসোসিয়েশন এবং পাস্ট ডিরেক্ট রিক্রুটেড অফিসার্স এ্যাসোসিয়েশনের (ডুরা) মধ্যে ২১ ফেব্রুয়ারি হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। ঘটনার দুই সপ্তাহ কেটে গেলেও এর রেশ এখনো কাটেনি। গত দুই সপ্তাহে এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে দোষী সাব্যস্ত করে দুইবার প্রশাসনের কাছে চিঠি দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কর্মকর্তাদের বিরোধ এভাবে চলতে থাকলে সেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। অতিদ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে সহ অবস্থান তৈরী করা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জরুরি।
সূত্র বলছে, ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে ফুল দিতে গেলে পাস্ট ডিরেক্ট রিকরুটেড অফিসার্স এ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের বাঁধা দেয় পাস্ট অফিসার্স এ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা। এক পর্যায়ে ডিরেক্ট রিক্রুটেড অফিসার্স এ্যাসোসিয়েশনের ফুলের ডালার ব্যানার খুলে নিয়ে যান পাস্ট অফিসার্স এ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা। এরপর দুই গ্রুপের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়। শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে না দেওয়ার প্রতিবাদে ঐ দিন (২১ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে অফিসার্স এ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তাদের দায়ি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বরাবর এই ঘটনার বিচার চেয়ে অভিযোগ পত্র দেন ডিরেক্ট রিক্রুটেড অফিসার্স এ্যাসোসিয়েশন (ডুরা)। ২৪ ফেব্রুয়ারি ডিরেক্ট রিক্রুটেড অফিসার্স এ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তাদের দায়ি করে রেজিস্ট্রার বরাবর পাল্টা অভিযোগ পত্র দেন অফিসার্স এসোসিয়েশন।
এই ঘটনায় ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো. হাবিবুল্লাহকে আহ্বায়ক করে প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি পাঁচ (০৫) তদন্ত কমিটি করা হলেও ২৪ ফেব্রুয়ারি উপাচার্যসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে স্মারক লিপি দেন ডিরেক্ট রিক্রুটেড অফিসার্স এ্যাসোসিয়েশন। ঐ স্মারকলিপিতে ২৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনার বিচার নিশ্চিত না হলে ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে লাগাতার কর্মবিরতির ঘোষণা দেন ডিরেক্ট রিক্রুটেড অফিসার্স এ্যাসোসিয়েশন। ২৬ তারিখের মধ্যে বিচার সম্পন্ন না হওয়ায় ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ২ মার্চ পর্যন্ত কর্মবিরতি পালন করেন ডিরেক্ট রিক্রুটেড অফিসার্স এ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা।
৩ মার্চ (রোববার) বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বরাবর দেওয়া এক চিঠিতে কর্মবিরতি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন ডিরেক্ট রিক্রুটেড অফিসার্স এ্যাসোসিয়েশন। ঐ চিঠিতে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ঘটনার সুষ্ঠু বিচারের আশ্বাস দেওয়ায় তারা কর্মবিরতি প্রত্যাহার করেছেন। তবে একই দিনে ২১ ফেব্রুয়ারি ডিরেক্ট রিক্রুটেড অফিসার্স এ্যাসোসিয়েশনের অভিযোগের ভিত্তিতে যে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে সেটি ৪ মার্চের মধ্যে বাতিলের জন্য রেজিস্ট্রার বরাবর চিঠি দিয়েছেন অফিসার্স এ্যাসোসিয়েশন। চিঠিতে উল্লেখ করা হয় তদন্ত কমিটি বাতিল না করলে যে কোন উদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরী হলে তার জন্য প্রশাসন দায় থাকবে।
সুত্র বলছে- প্রাবিপ্রবিতে কর্মকর্তাদের দুটি গ্রুপের মধ্যে বিরোধ দীর্ঘ দিনের ২০১৬ সালে অফিসার্স এসোসিয়েশনের যাত্রা শুরু হলে তার সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক হন বর্তমান পাস্ট ডিরেক্ট রিক্রুটেড অফিসার্স এ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক জিএম শামসাদ ফখরুল এবং সদস্য সচিব রফিকুল ইসলাম। জিএম শামসাদ ফখরুল এবং রফিকুল ইসলাম ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে যথাক্রমে একবার করে সংগঠনটির সভাপতি নির্বাচিত হন। অন্যদিকে অফিসার্স এ্যাসোসিয়েশনের বর্তমান সভাপতি হারুনুর রশিদ ডন একই প্যানেল থেকে এই দুইজনের সাথে দুই মেয়াদে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালের কর্মকর্তা পরিষদের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া নিয়ে জিএম শামসাদ ফখরুল এবং রকিবুল ইসলামের সাথে হারুনুর রশিদ ডনের মধ্যে মনোমালিন্য তৈরী হয়। যার ফলে ২০১৯ সালের নির্বাচনে দুইজন আলাদা প্যানেল থেকে নির্বাচন করেন।
তবে মূল বিরোধ শুরু হয় ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে চার (০৪) কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত পদে পদোন্নতিকে কেন্দ্র করে। ঐ মাসের ২৮ তারিখ জিএম শামসাদ ফখরুলসহ চার কর্মকর্তার পদন্নোতির বোর্ড থাকলে সেই বোর্ড বাতিলের দাবিতে উপাচার্যের কার্যালয়ের প্রধান ফটকে তালা দিয়ে আন্দোলন শুরু করেন অফিসার্স এ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা। পরিস্থিতি অনুকুলে না দেখে ঐ দিন বোর্ড বাতিল করে পরের দিন বোর্ড করার সিদ্ধান্ত নেন উপাচার্য। তবে পরের দিনেও বোর্ড শুরুর আগে উপাচার্যকে রুমে রেখে কার্যালয়ের প্রধান ফটকে তালা দেন কর্মকর্তারা। পরে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহযোগিতায় তালা ভেঙে বোর্ড শুরু করেন প্রশাসন এবং ঐ চার (০৪) কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
অফিসার্স এ্যাসোসিয়েশনের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্গানোগ্রামে কোন অতিরিক্ত পদ না থাকার পরেও উপাচার্য নিয়ম ভেঙ্গে চার (০৪) কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়েছেন। নিয়ম বহির্ভুত পদোন্নতি বন্ধের জন্য তারা সেদিন উপাচার্য কার্যালয়ে তালা দিয়েছেন।
অন্যদিকে জিএম শামসাদ ফখরুলের দাবি, যে চার কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে সেটি নিয়ম মেনেই হয়েছে। কিন্তূ চার কর্মকর্তা যেন বড় পদে না যেতে পারে সেটি আটকানোর জন্যই বোর্ডের দিন উপাচার্যের কার্যালয়ের ফটকে তালা দেন অফিসার্স এ্যাসোসিয়েশন।
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে জিএম শামসাদ ফখরুল সহ কয়েকজন কর্মকর্তা বিশ্ববিদ্যালেয়ে সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিয়ে নতুন সংগঠন খোলার সিদ্ধান্ত নেন। এই বছরের ৭ ফেব্রুয়ারী ‘ পাস্ট ডিরেক্ট রিক্রুটেড অফিসার্স এ্যাসোসিয়েশন (ডুরা)’ যাত্রা শুরু করে, যেখানে অফিসার্স এ্যাসোসিয়েশনের সাবের দুই সভাপতি জিএম শামসাদ যুখরুলকে আহ্বায়ক এবং রফিকুল ইসলামকে সদস্য সচিব করা হয়। এই সংগঠন শুরু হওয়ার পর কর্মকর্তাদের দুই গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি অফিসার্স এ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচনে হারুনুর রশিদ ডন সভাপতি নির্বাচিত হলে উত্তেজনা আরো বৃদ্ধি পায়। যার ফলে ২১ ফেব্রুয়ারি কর্মকর্তাদের দুই গ্রুপের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।
কর্মকর্তাদের দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে যাওয়ার বিষয়ে একে অপরকে দোষারোপ করছেন। অফিসার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হারুনুর রশিদ ডন বলেন, ‘আমরা এক সাথে থাকতে চেয়েছি কিন্তূ ওরা সেটা চায়নি। নির্বাচনের আগে ওদের সাথে বসে সব ভুল বোঝাবুজি মিটিয়ে ফেলতে চেয়েছি কিন্তূ ওরা আমাদের সাথে বসতে রাজি হয়নি। ওদের অধিকাংশেরই চাকুরির নিয়োগগত সমস্যা আছে। তাই ওরা প্রশাসনের পাশে থাকতে চায়। আর ওদেরকে আলাদাভাবে চলতে প্রশাসন সরাসরি ইন্দন দিচ্ছে।
পাস্ট ডিরেক্ট রিক্রুটেড অফিসার্স এ্যাসোসিয়েশনর (ডুরা) আহ্বায়ক জিএম শামসাদ ফখরুল বলেন, আমরা সংগঠন করেছি কর্মকর্তাদের মঙ্গলের জন্য। কিন্তূ একটা সময় এসে ওরা ব্যক্তিস্বার্থে সংগঠনকে ব্যবহার করতে শুরু করেছে। কর্মকর্তাদের বৈধ পদোন্নতিকে আটকে দেওয়ার জন্য আন্দোলন করেছে। অনিয়ম থেকে বের হয়ে আসার জন্য আমরা ওদেরকে সংশোধনের সুযোগ দেই কিন্তূ ওরা সংশোধন হয়নি। যার কারণে আমরা নতুন খুলেছি।’
কর্মকর্তাদের মধ্যে এমন বিরোধ কে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ক্ষতি হিসেবে দেখছেন অধিকাংশরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জেষ্ঠ্য শিক্ষক বলেন, ‘কর্মকর্তাদের মধ্যে যে বিরোধ তৈরী হয়েছে প্রশাসনের উচিত ছিল এটি প্রকাশ্য হওয়ার আগেই মিটিয়ে দেওয়া। প্রশাসন চাইলে এখনো এটা করতে পারে। কিন্তূ এটি না করলে সামনে বিরোধ আরো বাড়বে যার প্রভাব সরাসরি বিশ্ববিদ্যায়ের ওপর পড়বে।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হাফিজা খাতুনের পক্ষে জনসংযোগ ও প্রকাশনা দপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক ফারুক হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘কর্মকর্তাদের মধ্যে যে সমস্যা তৈরী হয়েছে তার একটা সুষ্ঠু সমাধান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন করবে। এই সমস্যাটি যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে না পড়ে সে ব্যাবস্থা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গ্রহণ করবে।