The Rising Campus
Education, Scholarship, Job, Campus and Youth
মঙ্গলবার, ৩রা ডিসেম্বর, ২০২৪

দিনে যারা ছাত্র, রাতে তারাই চাঁদাবাজ ও ছিনতাইকারী

জবি প্রতিনিধি: গতবছর ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে চাঁদপুর থেকে লঞ্চে ঢাকায় ফেরেন কবি নজরুল সরকারি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ুয়া শিক্ষার্থী সাব্বির হোসেন (ছদ্মনাম) ও তার বন্ধু ফয়সাল আহম্মেদ (ছদ্মনাম)। ঢাকার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে পৌঁছাতে রাত প্রায় ১ টা বেজে যাওয়ায় দুই বন্ধু হেঁটেই সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে ধোলাইখাল এলাকায় তাদের মেসের দিকে রওনা হোন। বাংলাবাজার ফুটওভার ব্রিজ পার হওয়ার পরপরই ৭ থেকে ৮ জন ২২ থেকে ২৫ বছর বয়সী যুবক তাদের টেনেহিঁচড়ে পাশেই ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ফটকের সামনে স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা বাসের আড়ালে নিয়ে যান। এরপর মারধর করে তাদের কাছ থেকে নগদ টাকা ও মোবাইল কেড়ে নেয় সেসব যুবক।

শুধু একটি ঘটনায় শেষ নয়। এমন ছিনতাইয়ের ঘটনা প্রায় প্রতি রাতেই ঘটছে বাংলাবাজার ফুটওভার ব্রিজ ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের মধ্যবর্তী এই এলাকায়। এমন প্রায় প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে জড়িত সেই ৭ থেকে ৮ জন যুবকের এই দলটি । গভীর রাতে লঞ্চে ঢাকায় ফেরা যাত্রীদের টার্গেট করে সর্বস্ব কেড়ে নেওয়াই তাদের কাজ। নগদ টাকা ও দামি মোবাইল ফোন ছিনতাই তাদের মূল টার্গেট। দিতে অস্বীকৃতি জানালে মারধরও করা হয় ভুক্তভোগীদের। সর্বস্ব কেড়ে নেওয়ার পর সেই ঘটনা পুলিশ বা অন্য কাউকে যাতে না জানায় সেজন্য দেয়া হয় প্রাণনাশের হুমকিও।

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য। প্রত্যক্ষদর্শী বাসের চালক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই এলাকায় ছিনতাইয়ে জড়িতে যুবকদের বেশিরভাগই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় ছাত্রলীগের পদধারী নেতা ও কর্মী। দিনে তাদের পরিচয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হলেও রাত হলেই পাল্টে যায় সেই পরিচয়। হয়ে যায় চাঁদাবাজ ও ছিনতাইকারী।

অনুসন্ধানে ও প্রত্যক্ষদর্শীদের মাধ্যমে এই ছিনতাই চক্রের সদস্যদের মধ্যে তিনজনের নাম ও পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। এই চক্রের সদস্যদের একজন সাজবুল ইসলাম। সে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী ও বিভাগীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। আরেক জনের নাম মীর মুকিত। তিনি অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ও বিভাগীয় ছাত্রলীগের ১ং যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক। আরেক সদস্যের নাম মৃদুল হাসান। তিনিও অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ও বিভাগীয় ছাত্রলীগের ২ং সহ-সভাপতি। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। এদের সাথে একই শিক্ষাবর্ষের আরও অন্তত ৪ থেকে ৫ জন সহযোগী রয়েছে বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা। পরিচয় পাওয়া তিনজনই বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস. এম. আকতার হোসাইনের অনুসারী।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তাকর্মীরা জানান, প্রায় প্রতিদিন রাত ১২টা থেকে ১টার পরপরই এসব যুবক দলবেঁধে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ফটক এলাকায় আসে। কখনোও একটা বা দুইটা বাইক সঙ্গে নিয়ে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ফটকের সামনে বসে গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা দেয় ও মাদক সেবন করে। কিছুক্ষণ পরপর বাইক নিয়ে শোডাউনও দেয় আশেপাশের এলাকায়। সামনে দিয়ে কোনো পথচারী গেলেই তারা তাদেরকে ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাহাদুরশাহ পরিবহনের বাসের আড়ালে নিয়ে মারধর করে নগদ টাকা ও মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়। বাহাদুর শাহ পরিবহনের কয়েকজন চালক ও সহকারীর সঙ্গে কথা বলেও উঠে এসেছে একই তথ্য। তাদের ভাষ্য, সামনেই এসব ঘটনা ঘটলেও ভয়ে তারা কোনো কথা বলতে পারেন না। নিজেদের নিরাপত্তার কারণে দেখেও না দেখার ভান করে থাকতে হয়।

খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, শুধু ছিনতাই নয়। ৭ থেকে ৮ জনের এই যুবকের দল মধ্যরাতে বাহাদুর শাহ পার্ক এলাকায় চলাচল করা ট্রাকের চালকদের কাছ থেকে প্রকাশ্যেই নিয়মিত চাঁদা আদায় করে। চাঁদার টাকা না দিলে ট্রাক চালকদের মারধরও করে তারা। কয়েকমাস আগে এক ট্রাক চালকের হাতে থাকা নগদ টাকা ছিনতাই করার পর প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজনের মধ্যস্থতায় সেই টাকা ফেরত দেয় তারা। শুধু তাই নয়, মধ্যরাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে দায়িত্বরত নিরাপত্তাকর্মীদের হুমকি-ধামকি দিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে মাদক সেবন করে বলেও অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। ভিতরে প্রবেশ করতে দেয়া না হলে নিরাপত্তাকর্মীদের গায়েও হাত দেয় তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নিরাপত্তাকর্মী বলেন, রাতে ডিউটি করলে খিদে পায়। তাই আমরা রাত দেড়টা-দুইটার দিকে সদরঘাটের দিকে কলা-রুটি খেতে যাই। গত ডিসেম্বরে এক রাতে যাওয়ার সময় দেখি দুইজন ছেলেকে তারা ৭ থেকে ৮ জনে ধরে বাসের চিপায় নিয়ে গেলো। পরে আমরা কলা-রুটি নিয়ে মূল ফটকে আসার পর দেখি সেই দুইজন ছেলে কাঁদতে কাঁদতে যাচ্ছে। তাদেরকে জিজ্ঞাসা করার পর তারা জানায় বাসের চিপায় নিয়ে তাদেরকে মারধর করে সাথে থাকা নগদ ৫০০ টাকা ও একজনের মোবাইল কেড়ে নেয়া হয়েছে। এমন ঘটনা প্রায় সময়ই দেখি যে ধরে বাসের চিপায় নিয়ে যাচ্ছে। কয়েকদিন আগেও এমন দেখেছি। তাদেরকে ভয়ে কিছু বলতে পারিনা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাহাদুর শাহ পরিবহন বাসের এক চালক বলেন, কয়েকদিন পরপরই রাতে এমন ঘটনা দেখি। ধরে এনে বাসের চিপায় নিয়ে টাকা পয়সা কেড়ে নেয়। তারা সবাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমরা তো ভয়ে কিছু বলতে পারিনা। তারা এখানে বসে মাদকও সেবন করে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক নিরাপত্তাকর্মী বলেন, প্রায় প্রতিদিনই রাত ১ টা-২ টার দিকে তারা আসে। সাথে বাইকও থাকে। বাইক নিয়ে শোডাউনও দেয়। দায়িত্বপালনকারী নিরাপত্তাকর্মীদের হুমকি-ধামকি দিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে মাদকও সেবন করে। আমরা ভয়ে বাধ্য হয়েই তাদের ঢুকতে দেই।

অভিযুক্ত মীর মুকিত চাঁদাবাজি ও পথচারীদের আটকে রেখে টাকা-মোবাইল কেড়ে নেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমার নামে তো এসব অভিযোগ থাকার কথা নয়। হয়ত ছাত্রলীগ করি তাই কেউ এমন করেছে। তাছাড়া এসব কাজের সাথে আমি সম্পৃক্ত নই।’

অভিযুক্তদের আরেকজন মৃদুল হাসান অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘এটা ইমপসিবল (অসম্ভব)। এমনিতে বললেই হয়ে যায় নাকি? কেউ প্রমাণ করতে পারবে আমি এভাবে টাকা-পয়সা নেই? সব মিথ্যা কথা ছড়ানো হয়েছে।’

অভিযুক্তদের আরেকজন সাজবুল ইসলামও অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘এসব ভিত্তিহীন। কেন এমন অভিযোগ করা হয়েছে তা আমার জানা নেই।’

এবিষয়ে জানতে চাইলে শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম আকতার হোসাইন বলেন, ‘এবিষয়ে আমার কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি। যদি এসবের প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে সে যেই হোক তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে কেউ অপরাধে জড়িত হলে ছাড় দেয়া হবেনা।’

এবিষয়ে কথা বলতে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. ইব্রাহীম ফরাজি কে মুঠোফোনে কয়েকবার ফোন দেয়া হলেও নাম্বার বন্ধ পাওয়া যায়। পরে হোয়াটসঅ্যাপে বারবার ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেন নি।

কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহিনুর রহমান বলেন, ‘বাংলাবাজার মোড় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে আমাদের পুলিশ মোতায়েন থাকে। এর মধ্যে পুলিশ টহলেও থাকে। এমন ঘটনা ঘটে থাকলে পুলিশ আরও বেশি তৎপর থাকবে।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মোস্তফা কামাল বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে এধরণের ঘটনা রোধে প্রক্টরিয়াল বডি তৎপর রয়েছে। আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে কথা বলবো যাতে তারা এসব রোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মানুযায়ী অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে’।

You might also like
Leave A Reply

Your email address will not be published.