দক্ষিণ কোরিয়ার শিল্প খাতে এমপ্লয়মেন্ট পারমিট সিস্টেমের (ইপিএস) আওতায় সরকারিভাবে প্রতিবছর কয়েক হাজার বাংলাদেশি কর্মী দেশটিতে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডের (বোয়েসেল) মাধ্যমে কয়েক ধাপে প্রার্থী নির্বাচনের পর দক্ষ কর্মীরা যেতে পারেন।
বোয়েসেলের তথ্যমতে, এ বছর আগস্ট মাস পর্যন্ত ৩ হাজার ১৭০ জন বাংলাদেশি কর্মী দক্ষিণ কোরিয়ায় গেছেন। আগামী তিন মাসে আরও প্রায় দুই হাজার কর্মী যাওয়ার সুযোগ পাবেন। আগামী বছর ৩ থেকে ৪ হাজার বাংলাদেশি কর্মী দক্ষিণ কোরিয়া যেতে পারবেন বলে আশা করছে বোয়েসেল।
বর্তমানে যেসব বাংলাদেশি কর্মী দক্ষিণ কোরিয়ায় কর্মরত, তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেখানে বাংলাদেশি কর্মীদের একজনের ন্যূনতম মাসিক আয় ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। ওভারটাইম করলে মাসে তিন লাখ টাকাও আয় করা যায়। বেতনের বাইরে থাকা-খাওয়ার টাকা কোম্পানি দেয়। প্রতি মাসে কেউ কেউ বাড়িতে পরিবারের জন্য ১ লাখ টাকা পাঠাতে পারেন।
ছয় ধাপ পেরিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায়
অনলাইনে নিবন্ধন করার মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়া যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরপর আরও পাঁচটি ধাপ অতিক্রম করতে হয় বলে জানান রাজীব কর। তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার গিয়ংগিদো প্রদেশে থেইল জংগোং কোম্পানিতে চাকরি করছেন। রাজীব কর বলেন, অনলাইনে বোয়েসেলের এই ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করার পর লটারি হয়। প্রতিবছর সাধারণত মার্চ-এপ্রিল মাসে নিবন্ধন শুরু হয়। এ বছরের নিবন্ধন ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। লটারিতে নাম আসলে ভাষা শেখার জন্য গড়ে প্রায় দুই মাস সময় পান প্রার্থীরা। এরপর ভাষা পরীক্ষায় বসতে হয়। এইচআরডি কোরিয়া ২০০ নম্বরের পরীক্ষা নেয়। এর মধ্যে রিডিং ১০০ এবং লিসেনিং ১০০। পরীক্ষার সময় ৫০ মিনিট।
কোরিয়ান ভাষা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে স্কিল টেস্ট পরীক্ষা নেওয়া হয় বলে জানান রাজীব কর বলেন। তিনি বলেন, এইচআরডি কোরিয়ার প্রতিনিধিরা প্রার্থীদের কাজ করার দক্ষতা যাচাই করেন। কিছু রিং দেয়, সেগুলো দ্রুত মেশিনে লাগাতে হয়। প্রার্থী কালার ব্লাইন্ড (বর্ণান্ধতা) কি না, সেটি পরীক্ষা করা হয়। এরপর প্রার্থীর নিজ নিজ জেলায় সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা দিতে হয়। সেখানে রক্ত পরীক্ষা, যক্ষ্মা ও হেপাটাইটিস ‘বি’ পরীক্ষা করা হয়। স্বাস্থ্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে নিজ থানা থেকে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স নিতে হয়।
রাজীব কর ইপিএসের আওতায় দুইবার দক্ষিণ কোরিয়া যাওয়ার সুযোগ পান। ২০০৯ সালে একবার। এরপর আবার ২০১৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়া যান। তিনি বলেন, এখানে দীর্ঘদিন থাকার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি আসার আগে ভালোভাবে কোরিয়ান ভাষা ও এখানকার কিছু সংস্কৃতি শিখে আসলে সুবিধা পাওয়া যায়। কোরিয়ানদের ব্যবহার ভালো। কাজ করতে পারলে এখানে মাসে তিন লাখ টাকাও আয় করা সম্ভব।
খরচ ও জামানত
বোয়েসেলের মাধ্যমে সরকারিভাবে দক্ষিণ কোরিয়া যাওয়ার খরচ খুবই কম বলে জানান আকন মিলন। দক্ষিণ কোরিয়ার ইয়ংইন শহরে একটি কোম্পানিতে চাকরি করছেন তিনি। আকন মিলন প্রথম আলোকে বলেন, বোয়েসেলের সার্ভিস চার্জসহ সব মিলে একজন কর্মীকে ৩৩ হাজার ৫২৪ টাকা জমা দিতে হয়।
বোয়েসেলের সার্ভিস চার্জ বাদে বিমানভাড়ার টাকা কর্মীকে দিতে হয় বলে জানান আকন মিলন। তিনি বলেন, মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে এখন চার্টার্ড ফ্লাইটে আসতে হয়। জনপ্রতি ৭৭ হাজার টাকা ভাড়া। অন্যান্য সময়ে বিমানভাড়া ৫০ হাজার টাকার মধ্যে থাকে। করোনা পরিস্থিতিতে কোয়ারেন্টাইনের জন্য ২০ হাজার টাকা দিতে হয়। এ ছাড়া ১ লাখ টাকা জামানত হিসেবে রাখতে হয়। এই টাকা পরে ফেরত পাওয়া যায়। এর বাইরে আর কোনো খরচ নেই।
আকন মিলন আরও বলেন, দক্ষিণ কোরিয়া আসতে বোয়েসেলের কাছ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা পেয়েছি। এখানে আসার পরও বোয়েসেল সহযোগিতা করে থাকে। বোয়েসেল থেকে সব সময় বলা হয়, কোথাও কোনো ঝামেলায় পড়লে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে।
ইউটিউবেও কোরিয়ান ভাষা শেখেন অনেকে
বোয়েসেল থেকে জানানো হয়, অনলাইনে নিবন্ধন করার পর যাঁরা কোরিয়ান ভাষা জানেন না, তাঁরা কোরিয়ান ভাষা শেখার সময় পান। সরকারিভাবে সারা দেশে ৪০টি কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে কোরিয়ান ভাষা শেখানো হয়। তবে অনেকে ইউটিউবে ভিডিও দেখে দেখে কোরিয়ান ভাষা শিখেন। ভাষা শিখে তাঁরা কোরিয়ায়ও গেছেন।
দক্ষিণ কোরিয়ার খিয়ংগিদো প্রদেশে টিএলএইচ কোম্পানিতে টেকনিশিয়ান হিসেবে চাকরি করেন মো. নুরুল আবছার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, লটারিতে নাম আসার পর ভাষা শেখার জন্য দুই মাসেরও কম সময় পাই। ভাষা শেখার জন্য একটি বেসরকারি কোচিং সেন্টারে গিয়ে হতাশ হয়ে ফিরে আসি। পরে নিজে নিজে ইউটিউব ও গুগল ট্রান্সলেটের মাধ্যমে ৫০ দিনের মধ্যে ভাষা শিখি।
মো. নুরুল আবছার বলেন, ভাষা শেখার পর বাকি ধাপগুলো সহজ ছিল। স্কিল টেস্ট পরীক্ষায় পাস করে তালিকাভুক্ত হওয়ার প্রায় এক বছর পর ভিসা পাই। ২০১৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর কোরিয়ায় আসি। বর্তমানে মাসে বাংলাদেশি টাকায় ২ লাখ টাকা বেতন পাই। এখানে থাকা ও খাওয়ার খরচ প্রতিষ্ঠান বহন করে। নিজের ব্যক্তিগত খরচ ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকায় হয়ে যায়। বলতে গেলে বেতনের পুরোটাই জমানো যায়।