The Rising Campus
Education, Scholarship, Job, Campus and Youth
বৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪

দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ঐতিহাসিক জয় বাংলাদেশের

৪৬তম ওভারের তৃতীয় বলে মেহেদী হাসান মিরাজের বলে ডেভিড মিলার স্ট্যাম্প আউট হয়ে যাওয়ার পরই ধারাভাষ্যকাররা বলে দিয়েছেন, ম্যাচটা এখানেই শেষ। দক্ষিণ আফ্রিকার পরাজয় নিশ্চিত। বাকি ছিল আর কতদুর যেতে পারে স্বাগতিক প্রোটিয়ারা।

শেষ দিকে কেশভ মাহারাজ এবং লুঙ্গি এনগিদি কয়েকটি চার-ছক্কা মেরেছিলেন ঠিকই, কিন্তু বাংলাদেশের ঐতিহাসিক জয় আর ঠেকাতে পারেনি তারা।

রীতিমত ঘোষণা দিয়ে গিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ঐতিহাসিক প্রথম জয়ের দেখা পেলো বাংলাদেশ। ৩১৫ রানের লক্ষ্য ছুড়ে দিয়ে ৪৮.৫ ওভারে প্রোটিয়াদের অলআউট করে দিয়েছে ২৭৬ রানে। ৩৮ রানের জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছে তামিম ইকবাল অ্যান্ড কোং।

ব্যাট হাতে সাকিব-রাব্বির পর বল হাতে প্রোটিয়া শিবিরে কাঁপন ধরিয়েছেন মেহেদী হাসান মিরাজ, তাসকিন আহমেদ এবং শরিফুল ইসলাম। ৪ উইকেট নিয়ে প্রোটিয়াদের বিপক্ষে সবচেয়ে সফল মিরাজ। ৩ উইকেট নিয়ে স্বাগতিকদের কোমর ভেঙে দিয়েছিলেন তাসকিন আহমেদ। আর গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ব্রেক থ্রু এনে দিয়ে ২ উইকেট নিয়েছেন শরিফুল ইসলাম।

এর আগে প্রোটিয়াদের মাটিতে তাদের বিপক্ষে কোনো ফরম্যাটেই কোনো ম্যাচ জেতেনি বাংলাদেশ। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে গিয়ে ৯বার মুখোমুখি হযেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু কোনোবারই জয়ের স্বাদ নিতে পারেনি। জয় তো দূরে থাক, নূন্যতম লড়াই করারও সাহস দেখাতে পারেনি টাইগাররা। সবচেয়ে ছোট ব্যবধানে পরাজয় ছিল ৬১ রানে (২০০৮ সালের ৭ নভেম্বর পচেফস্ট্রমে)।

সে জায়গায় এবার দেশ ছাড়ার আগেই তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসান এবং কোচ রাসেল ডোমিঙ্গোরা বলছিলেন, অন্তত একটি জয় হলেও পেতে চান তারা।

রাসেল ডোমিঙ্গো তো বলেই দিয়েছিলেন, এবার তিনি এমন কিছুর আশা করছেন, যা দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে আগে কখনো হয়নি। শেষ পর্যন্ত সেঞ্চুরিয়নের সুপার স্পোর্টস পার্কে সিরিজের প্রথম ম্যাচেই সেটা করে দেখালো বাংলাদেশ। তুলে নিলো দুর্দান্ত এক জয়।

যেন ঠিক ছকে আঁকা একটি ম্যাচ ছিল এটা। টস জিতুক আর না জিতুক, প্ল্যান কার্যকর করার সব চিন্তাই হয়তো তৈরি করা ছিল। যে কারণে টস হেরে ব্যাট করতে নামলেও সেটা খুব একটা প্রভাব পড়েনি ম্যাচে গেম প্ল্যান কার্যকরে। সেঞ্চুরিয়নের মাঠ ছোট, এখানে রান ওঠে। ব্যাটাররা অনেক রানের দেখা পায়। প্রোটিয়ারা নিজেরাই তো এর আগে এই মাঠে কত ম্যাচে রানের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল!

বাংলাদেশ ব্যাট করতে নে,শুরুটা ভালো করেছিল। তামিম-লিটন মিলে ৯৫ রানের যে জুটি গড়েছিলেন, সেখানেই গড়ে উঠেছিল আত্মবিশ্বাস। যে কারণে তিন ফিফটিতে বাংলাদেশের রান পার হলো ৩০০। ৩১৪ রানে গিয়ে থামলো টাইগাররা। আফগানিস্তান সিরিজে নিজেকে প্যাসেঞ্জার মনে করা সাকিব আল হাসানই ছিলেন সবচেয়ে সফল। মাঠের খেলায় নিজেকে যে নিবেদিত করতে পারেন, সাকিব তার বড় উদাহরণ। ৬৪ বলে তিনি খেললেন ৭৭ রানের ইনিংস।

তামিম ইকবাল বোলিংয়ের শুরুটাও করালেন সাকিবকে দিয়ে। কিন্তু প্রথম ব্রেক থ্রু এনে দিলেন শরিফুল। এরপর এক ওভারেই প্রোটিয়া টপ অর্ডারে বড় ধাক্কা দিলেন তাসকিন। ৩৬ রানে নেই ৩ উইকেট। এরপর টেম্বা বাভুমা আর রাশি ফন ডার ডুসেন মিলে ৮৫ রানের জুটি গড়ে ম্যাচটাকে বের করে নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শরিফুল এসে তাদের চেষ্টা ভেঙে দিলেন।

রাফি ফন ডার ডুসেন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিলেন, ৮৬ রান করে চেষ্টা করেন ম্যাচ বের করে নেয়ার। কিন্তু তাসকিনের ডেলিভারিতে রাব্বির দারুণ ক্যাচে পরিণত হয়ে তারও চেষ্টার সমাধি হলো। ডেভিড মিলার তার সেই ‘কিলার মিলার’ উপাধিটাকে ফিরিয়ে আনার প্রয়াস পেয়েছিলেন। কিন্তু মিরাজের বুদ্ধিদীপ্ত বোলিংয়ের সামনে হার মানলেন তিনিও। ৭৯ রান করেই তাই তিনি রয়ে গেলেন পরাজিতের কাতারে।

৩১৫ রানের বিশাল লক্ষ্য। যদিও দক্ষিণ আফ্রিকা ঘরের মাঠে সব সময়ই শক্তিশালী। কিন্তু উল্টোদিকে ওয়ানডে ফরম্যাটটা বাংলাদেশ ভালো খেলে এবং এই ফরম্যাটে প্রোটিয়াদের হারানোর বেশ কয়েকবারের অভিজ্ঞতাও আছে টাইগারদের। যদিও প্রোটিয়াদের বিপক্ষে এসব জয় ছিল ঘরের মাঠ কিংবা বিদেশের মাটিতে। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে নয়।

সে কারণেই সাকিব-তামিমরা বলে আসছিলেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় অন্তত একটি জয় চাই। সে লক্ষ্যে প্রথম ওয়ানডেতে বাংলাদেশের ব্যাটাররা নিজেদের কাজটি করে দিয়েছেন। এরপর বোলারদের হাতে ছিল ম্যাচ। শেষ পর্যন্ত তারাও প্রমাণ করলো নিজেদের।

জয়ের লক্ষ্যে শুরুটা দারুণ হলো বাংলাদেশের। চতুর্থ ওভারেই প্রোটিয়া ওপেনার জানেমান মালানের উইকেট তুলে নেন বাঁ-হাতি পেসার শরিফুল ইসলাম। তার বলে ব্যাটের কানায় লাগিয়ে উইকেটের পেছনে মুশফিকের হাতে ক্যাচ দেন মালান। দুর্দান্ত ক্যাচটি তালুবন্দী করেন মুশফিকুর রহিম।

প্রায় মাটিতে লাগতে যাওয়া বলটি এক ঝলকে গ্লাভসে তুলেন টাইগার উইকেটরক্ষক। দক্ষিণ আফ্রিকা ইনিংসে প্রথম আঘাত আসলো দলীয় ১৮ রানের মাথায়।

আম্পায়ারও অবশ্য নিশ্চিত ছিলেন না ক্যাচের ব্যাপারে। সফট সিগন্যাল ‘নটআউট’ দিয়ে থার্ড আম্পায়ারের কাছে পাঠালেন। তাতে দেখা গেলো বল ব্যাটে লেগেছে, ক্যাচও পরিষ্কারভাবেই গ্লাভসবন্দী করেছেন মুশফিক।

শরিফুলের বোলিং তোপের পরপরই আক্রমণে নিয়ে আসা হয় ডান-হাতি পেসার তাসকিন আহমেদকে। তামিমের এই আস্থার প্রতিদান দিলেন তাসকিন। সাফল্য এনে দিতে খুব বেশি সময় নেননি তিনি। একই ওভারে পরপর প্রোটিয়াদের টপ অর্ডারের দুই ব্যাটারকে সাজঘরের পথ দেখিয়ে দেন।

শরিফুলের বলে ১৮ রানের মাথায় পড়ে প্রোটিয়াদের প্রথম উইকেট। তাসকিনের বলে ৩৬ রানের মাথায় পড়লো দ্বিতীয় উইকেট। ৮ম ওভারের ১ম বলে উইকেট পড়ার পর চতুর্থ বলে পড়লো আরো এক উইকেট। এবার প্রোটিয়াদের নির্ভরযোগ্য ব্যাটার এইডেন মারক্রামকে মিরাজের ক্যাচে পরিণত করলেন তাসকিন।

ব্যক্তিগত ২১ রানে তাসকিনের বলে এলবিডব্লিউর ফাঁদে পড়েন অপর ওপেনার কাইল ভেরাইনি। তাসকিনের ওভারের প্রথম বলে রিভিউ নেয়ারও সুযোগ পেলেন না তিনি। আম্পায়ার আঙ্গুল তুলতেই প্যাভিলিয়নের পথ ধরেন তিনি। ওভারের ৪র্থ বলটি ছিল ফুলার লেন্থ। ক্যাচ ওঠে পয়েন্টের কাছে। মিরাজ খুব সহজেই সেটিকে তালুবন্দী করলেন।

তাসকিনের এক ওভারেই কাঁপন ধরে যায় দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিং লাইনআপে। ৩৬ রানে ৩ উইকেট পড়ার পর ম্যাচে ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে দক্ষিণ আফ্রিকার দুই ব্যাটার টেম্বা বাভুমা এবং রাশি ফন ডার ডুসেন। তারা দু’জন প্রাথমিক চেষ্টায় সফল হওয়ার পর নজর দেন রানের গতি বাড়ানোর দিকে।

৮৫ রানের জুটি গড়েন অধিনায়ক টেম্বা বাভুমা এবং রাশি ফন ডার ডুসেন। ২৭তম ওভারে নিজের ৬ষ্ঠ ওভার বল করতে এসে ব্রেক থ্রু উপহার দিলেন শরিফুল। তার বলে উইকেটের পেছনে মুশফিকের হাতে ক্যাচ দেন প্রোটিয়া অধিনায়ক। ৫৫ বলে ৩১ রান করে আউট হন তিনি।

টেম্বা বাভুমা আউট হলেও রাশি ফন ডার ডুসেন যেন বাংলাদেশের হাত থেকে ম্যাচটা নিতে যাচ্ছিলেন। বেশ কয়েকবার আউটের সুযোগ তৈরি হয়েছিল; কিন্তু প্রতিবারই বেঁচে যান তিনি।

অবশেষে ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন তাসকিন আহমেদ। ভয়ঙ্কর থেকে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা রাশি ফন ডার ডুসেনকে ইয়াসির আলী রাব্বির হাতে দুরহ ক্যাচে পরিণত করে সাজঘরের পথ দেখালেন তিনি। ৩৮তম ওভারের প্রথম বলেই তাসকিনকে ডিপ ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগে খেলতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দেন ফন ডার ডুসেন। দৌড়ে এসে সেই ক্যাচ তালুবন্দী করেন ইয়াসির। ৮৬ রান করে আউট হন তিনি।

ফন ডার ডুসেন আউট হওয়ার পর দ্রুত রান তুলে আবার বাংলাদেশের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ান ডেভিড মিলার। যদিও এর মধ্যে আন্দিল পেহলুকাইয়ো, মার্কো জানসেন, কাগিসো রাবাদার উইকেট নিয়ে বাংলাদেশকে ম্যাচে ধরে রাখেন মেহেদী হাসান মিরাজ।

তবে ৪৬তম ওভারের তৃতীয় বলেই আসল কাজটি করে দেন তিনি। মিরাজকে ড্যান্সিং ডাউন দ্য উইকেটে খেলতে এসে বল মিস করেন মিলার। স্ট্যাম্পিং করতে অভিজ্ঞ উইকেটরক্ষক মুশফিকুর রহিমের বিন্দমাত্র বিলম্ব হয়নি। ৫৭ বলে ৭৯ রান করেন তিনি। ৮টি বাউন্ডারির সঙ্গে ছক্কা মারেন ৩টি। শেষ দিকে ১৬ বলে ২৩ রান করে কেশভ মাহারাজ এবং লুঙ্গি এনগিদি ১০ বলে ১৫ রান করে শুধু পরাজয়ের ব্যবধানই কমিয়েছেন।

তবুও মাহমুদউল্লাহর বলে কেশভ মাহারাজ যখন এলবিডব্লিউ হলেন, আম্পায়ার আউট দিতে চাইলেন না। খুব আত্মবিশ্বাসী মাহমুদউল্লাহ সঙ্গে সঙ্গেই ডিআরএস চাইলেন। তিনি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বারবার বলছিলেন, এটা আউট। শেষ পর্যন্ত টিভি রিপ্লেতে দেখা গেলো তিনি সঠিক এবং আম্পায়ার বোঙ্গানি জেলে ক্ষমা চেয়ে আউটের ঘোষনা দিলেন।

সংক্ষিপ্ত স্কোরকার্ড

টস: দক্ষিণ আফ্রিকা
বাংলাদেশ: ৩১৪/৭, ৫০ ওভার (সাকিব আল হাসান ৭৭, লিটন দাস ৫০, ইয়াসির আলি রাব্বি ৫০, তামিম ইকবাল ৪১, মাহমুদউল্লাহ ২৫, মিরাজ ১৯*; মার্কো জানসেন ২/৫৭, কেশভ মাহারাজ ২/৫৬, রাবাদা ১/৫৭)।

দক্ষিণ আফ্রিকা: ২৭৬/১০, ৪৮.৫ ওভার (রাশি ফন ডার ডুসেন ৮৬, ডেভিড মিলার ৭৯, টেম্বা বাভুমা ৩১, কাইল ভেরাইনি ২১, কেশভ মারাহাজ ২৩, লুঙ্গি এনগিদি ১৫*; মেহেদী হাসান মিরাজ ৪/৬১, তাসকিন আহমেদ ৩/৩৬, শরিফুল ২/৪৭, মাহমুদউল্লাহ ১/২৪)।

ফল: বাংলাদেশ ৩৮ রানে জয়ী।
ম্যান অব দ্য ম্যাচ: সাকিব আল হাসান।

You might also like
Leave A Reply

Your email address will not be published.