ঢাবি প্রতিনিধি: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে মানসিক ভারসাম্যহীন যুবক তোফাজ্জল হোসেনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় সরাসরি জড়িত আরও সাত শিক্ষার্থীর নাম উঠে এসেছে পুলিশি তদন্তে। পুলিশ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের নাম-পরিচয় প্রকাশ না করলেও অনুসন্ধান বলছে, জড়িতরা ক্যাম্পাসে দিব্যি প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং থাকছেন হলে।
এ নিয়ে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্টতা আছে এমন ১৫ জনকে শনাক্ত করা গেছে। হল প্রশাসন গঠিত কমিটির তদন্তে তোফাজ্জল হত্যায় সরাসরি জড়িত আট শিক্ষার্থীর সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। তাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, বাকি দুজন পলাতক। তবে এ দুজনসহ সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাওয়া অন্য নয়জনকে গ্রেপ্তারের সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে বলে দাবি করেছে পুলিশ।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে ফজলুল হক মুসলিম হলের দক্ষিণ ভবনে গেস্ট রুমে ৩২ বছর বয়সী মানসিক ভারসাম্যহীন তোফাজ্জল হোসেন নির্যাতনের শিকার হন। পরে কয়েকজন শিক্ষার্থী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে মরদেহের ময়নাতদন্ত করেন ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসকরা। মর্গ সূত্রে জানা যায়, তোফাজ্জলের দুই হাত ও দুই পায়ে পেটানোর আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে।
পিটিয়ে হত্যার এ ঘটনা জানাজানির পর দেশ জুড়ে সমালোচনা শুরু হয়। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মামলা করার পর ছয় শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ, যারা আদালতে দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। পরে তাদের কারাগারে পাঠায় আদালত। তোফাজ্জল হত্যার ঘটনায় হল প্রশাসনের তদন্ত কমিটি আট ছাত্রের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাওয়ার পর তাদের সাময়িক বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরে গ্রেপ্তার ছয়জনের জবানবন্দি এবং পুলিশের তদন্তে নতুন করে আরও সাতজনের সংশ্লিষ্টতার তথ্য উঠে আসে। এ ছাড়া তোফাজ্জল হত্যার ঘটনা তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
তোফাজ্জল হত্যার ঘটনায় ফজলুল হক মুসলিম হল প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী এ ঘটনায় সম্পৃক্ত আট শিক্ষার্থীর মধ্যে ছয়জন হলেন পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের মো. মোত্তাকিন সাকিন শাহ, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের জালাল মিয়া, মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের সুমন মিয়া, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের আল হোসাইন সাজ্জাদ, গণিত বিভাগের আহসান উল্লাহ ও সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের ওয়াজিবুল আলম। এ ছয়জনকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার
করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বাকি দুই শিক্ষার্থী হলেন উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ফিরোজ কবির ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের আবদুস সামাদ। তারা এখনো পলাতক।
এদিকে এ ঘটনায় হল প্রশাসনের দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টি উঠে আসার পর হল প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. শাহ মো. মাসুমকে অব্যাহতি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তার স্থলে অধ্যাপক ড. মো. ইলিয়াস আল- মামুনকে হলটির নতুন প্রভোস্ট করা হয়। শিক্ষার্থীরা বলছেন, হল প্রশাসন তৎপর থাকলে এমন একটি ঘটনা ঘটত না। কোনোভাবেই তারা দায় এড়াতে পারে না। হলের তদন্ত কমিটিতে আসা নামের বাইরেও অনেকে জড়িত। তারা এখনো দিব্যি প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দ্রুত তাদের আইনের আওতায় এনে বিচার নিশ্চিত করতে হবে। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আরও বেশি তৎপর থাকা উচিত।
ফজলুল হক মুসলিম হলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আবাসিক শিক্ষার্থী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ ঘটনায় মাত্র আটজনকে শনাক্ত করতে পেরেছে হল প্রশাসন। আরও অনেকেই জড়িত আছেন, তারা প্রকাশ্যেই ঘুরছেন। হল বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তেমন তৎপরতা দেখছি না। যাদের নাম আসছে তদন্তে তাদের মধ্যে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, বাকি দুজন পলাতক। যাদের নাম আসেনি তারা ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে ঘুরছেন, হলেও থাকছেন।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘হলের প্রাথমিক তদন্ত কমিটিতে আটজনের নাম আসে। পুলিশের তদন্তে এ হত্যায় সরাসরি জড়িত আরও সাতজন শিক্ষার্থীর নাম উঠে এসেছে। তাদেরও গ্রেপ্তারে পুলিশ তৎপর আছে। এ ছাড়া আমরা সিন্ডিকেট সভায় আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করব। সেখান থেকেও জড়িত আরও কয়েকজনের নাম আসতে পারে। এ ছাড়া যাদের সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে, তাদের স্থায়ী বহিষ্কার করা হতে পারে। অপরাধীরা কোনোভাবেই ছাড় পাবে না। আমরা তৎপর আছি।’
তোফাজ্জল হত্যায় নতুন করে আরও কয়েকজনের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাওয়ার বিষয়টি দেশ রূপান্তরকে নিশ্চিত করেছেন এ ঘটনায় হওয়া মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহবাগ থানার এসআই আমিনুল ইসলাম। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘হল প্রশাসনের তদন্ত কমিটির বাইরেও আমরা কয়েকজনের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছি। তাদের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের সহযোগিতা করছেন। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।’
নিহত তোফাজ্জল বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠালতলী ইউনিয়নের তালুকের চরদুয়ানী গ্রামের মৃত আবদুর রহমানের ছেলে এবং কাঁঠালতলী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। প্রায় ১০ বছর আগে তার বাবা মারা যান। এর দুই বছর পর মা এবং সাত বছর পর একমাত্র বড় ভাই মারা যান। এরপর থেকেই পরিবার ও অভিভাবকহীন হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতেন তোফাজ্জল। বরিশাল বিএম কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে বঙ্গবন্ধু ল কলেজে অধ্যয়নরত ছিলেন। এরই মধ্যে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন।
চাচাতো ভাই ফারুক মিয়া বলেন, ‘তোফাজ্জল হত্যার মূল হোতাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। আমরা এমন নির্মম হত্যাকাণ্ড আর দেখতে চাই না।’