বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের যানবাহনে হাফ পাসের জন্য আন্দোলন হয়েছে। এরপর হাফ পাসের দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যানটিনগুলোতে নিম্নমানের খাবার নিয়ে প্রায়ই কথা শোনা যায়। ক্যানটিনের এ খাবারে ভরপুর থাকে কার্বোহাইড্রেট আর নামমাত্র সামান্য প্রোটিন। নেই কোনো বৈচিত্র্য আর অন্য পুষ্টিগুণ ওতে নেই বললেই চলে। যদিও একই এই গতানুগতিক খাবার চলছে বছরের পর বছর।
জীবনের দীর্ঘ সময় বিশ্ববিদ্যালয় হলে থেকে ক্যানটিনের এ খাবার খেয়ে মেধা বিকাশ ও সৃজনশীল হওয়া দুঃসাধ্যই বটে। শিক্ষার্থীদের মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো অবস্থা হয় হলগুলোর গণরুম। গাদাগাদি করে বাস করা গণরুমের শিক্ষার্থী কীভাবে পারে দুশ্চিন্তামুক্তভাবে শুধুই পড়াশোনায় ফোকাস করতে?
অন্যদিকে প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাসেবার নামে মিনি চিকিৎসালয় থাকে। ওখানে চিকিৎসা বলতে প্রাথমিক চিকিৎসা আর তিন বেলা প্যারাসিটামল, হিস্টাসিন, সিনামিন আর ওরস্যালাইনের প্যাকেটের ব্যবস্থা। আমরা মুখেই বলি ‘একজন শিক্ষার্থী জাতির ভবিষ্যৎ’ আদতে সেই ভবিষ্যতের রাস্তা আমরা কণ্টকপূর্ণ করে রেখেছি। শিক্ষার আন্তর্জাতিক মান ধরে রাখতে সরকারকে শিক্ষার্থীবান্ধব হওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। দেশের উন্নয়ন আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার জন্য শিক্ষার্থীদের পথ মসৃণ করা ছাড়া আর কোনো দ্বিতীয় পথ থাকতে পারে না। উন্নয়ন উন্নয়ন বলে গলা ফাটিয়ে নিজের ঢোল নিজে পেটানো আর ‘মুখেন মারিতং জগৎ’ ছাড়া এর বেশি কিছুই করা সম্ভব নয়। বিনা মূল্যে শিক্ষা, শিক্ষার্থীদের পরিচ্ছন্ন থাকার ব্যবস্থা, যানবাহনসেবা, স্বাস্থ্যসেবা, খাবারের মান, বিনা মূল্যে আইনি সেবা ইত্যাদি পারে একজন শিক্ষার্থীকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নতি করতে এবং তাদের দ্বারাই দেশের সম্মান ও উন্নয়ন বয়ে আনতে।
পৃথিবীর অন্যতম উন্নত রাষ্ট্র ও জ্ঞান–বিজ্ঞানের তীর্থস্থান জার্মানি কেমন শিক্ষার্থীবান্ধব—এবার সেই প্রসঙ্গে আসছি এবং এই আসাটা আসলে বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনার জন্য নয়। আমাদের ঘাটতি কোথায় এবং কেন আমরা এগিয়ে যেতে পারছি না, এইটুকু জানার জন্য তথ্যগুলা জেনে রাখা ভালো।
জার্মানিতে বাসাভাড়া থেকে শুরু করে ক্যানটিনে খাওয়াদাওয়া, যানবাহনে ভ্রমণ, স্বাস্থ্যসেবা এমনকি আইনজীবীর সাহায্য পেতেও শিক্ষার্থীরা বিশেষ সুবিধা পান। মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রতিষ্ঠিত নাগরিক ও চাকরিজীবীদের ঘাড় ভেঙে টাকা আদায় করে সেই টাকা দিয়েই শিক্ষার্থীদের সুযোগ–সুবিধা নিশ্চিত করা হয়। শিক্ষার্থীদের এত্ত এত্ত সুযোগ–সুবিধা পাওয়া দেখলে নিজেরই হিংসা হয়—ইশ! সারা জীবন যদি শিক্ষার্থী থেকে যেতে পারতাম!
প্রথমত, বাসাভাড়ার ক্ষেত্রে জার্মানিতে সব থেকে বাড়াবাড়ি রকমের যে সমস্যা হয়, সেটা হলো বছর শেষে অতিরিক্ত একটা টাকা গুনতে হয় এবং এটা নির্ভর করে ভাড়াটে কতটুকু বিদ্যুৎ, পানি ও রুম হিটার ব্যবহার করছে। যদিও মাস শেষে প্রত্যেক ভাড়াটে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা বিদ্যুৎ বিল ও পানির বিল হিসেবে পরিশোধ করেন। বছর শেষে এই উটকো টাকার পরিমাণ ব্যবহারের তারতম্যভেদে ৫০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। আবার ভাড়াটে একেবারেই কিপ্টামি করে চললে টাকা ফেরতও পেতে পারেন। তবে ফেরত পাওয়ার ঘটনা খুব বিরল। ইতিবাচক খবর হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা এ–জাতীয় ঝামেলা থেকে মুক্ত। শিক্ষার্থীদের জন্য নির্দিষ্ট আবাসনগুলোতে এদের মাসিক ভাড়ার অতিরিক্ত কোনো টাকা গুনতে হয় না। সে সারা বছর ধরে যতটুকুই বিদ্যুৎ বা পানি খরচ করুক না কেন। জার্মানদের মতো একটা মিতব্যায়ী ও কৃপণ জাতির কাছ থেকে পাওয়া উপহার শিক্ষার্থীদের জন্য একটা বিরাট মজার ব্যাপার।
পাবলিক যানবাহনে শিক্ষার্থীদের চলাফেরা করার জন্য কোনো টিকিট বা টাকা খরচ করতে হয় না। স্টুডেন্ট কার্ড দেখালেই ল্যাটা চুকে যায়। এবার অনেক শিক্ষার্থী যাঁরা জার্মানিতে পড়ছেন, তাঁরা রেগে গিয়ে বলতে পারেন, ‘এটা মিথ্যা কথা! ছয় মাস পরপর টিকিটের জন্য টাকা জমা দিচ্ছি তো।’
তাহলে এবার একটু বিস্তারিত বলি। প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশন চার্জের নামে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা জমা করতে হয়। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে দেড় শ থেকে পাঁচ শ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ টাকার সিংহভাগ যায় পরিবহন খাতে।
যেমন জার্মানির স্যাক্সনি আনহাল্ট অঙ্গরাজ্যের হালে শহরে মার্টিন লুথার বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশন চার্জ (ছয় মাস অন্তর) ২৪ হাজার টাকা। এ টাকার মধ্যে ১৫ হাজার টাকা পাবে পরিবহন অফিস। বিশ্ববিদ্যালয় নেবে ৮ হাজার টাকা এবং শিক্ষার্থী কল্যাণ তহবিলে যাবে ১ হাজার টাকার মতো। হাজার হাজার টাকার অঙ্ক শুনে অনেক টাকা মনে হলেও একজন শিক্ষার্থী পার্ট টাইম চাকরি করে যা আয় করেন, তার তুলনায় ছয় মাসের ব্যবধানে এসব ১৫ হাজার, ২৪ হাজার টাকা কোনো টাকাই না বরং পয়সা।
অর্থাৎ জার্মানিতে একজন শিক্ষার্থীর আদর দেখলে জামাই আদর টাইপ মনে হতে পারে। যানবহনে ফ্রি ঘোরার একটা নির্দিষ্ট এলাকা থাকে। যদিও মুক্তভাবে জার্মানির পুরো দু–একটা অঙ্গরাজ্যজুড়ে ঘুরেফিরে বেড়ানোর জন্য এই একটা স্টুডেন্ট কার্ড যথেষ্ট। একজন শিক্ষার্থীর জন্য দিনে ২৪ ঘণ্টা ফ্রি ভ্রমণে বাস, ট্রেন, ট্রাম উন্মুক্ত থাকে।
যদিও একজন সাধারণ যাত্রীর জন্য জার্মানিতে বাস, ট্রাম, ট্রেনের টিকিট যথেষ্ট ব্যয়বহুল। সব যানবহনে টিকিট চেকার অন্য সব টিকিট উল্টে–পাল্টে স্ক্যান করে পরীক্ষা করলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের স্টুডেন্ট কার্ড দূর থেকে দেখামাত্রই ধন্যবাদ দিয়ে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যায়। এটাও একটা সম্মান।
শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিমাও একটু আলাদা রকমের সেবা দেয়। ৩০ বছরের নিচে যেকোনো শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্যবিমা নির্দিষ্ট করা থাকে এবং সরকার অনুমোদিত বিমা কোম্পানিভেদে ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকার মধ্যে। যদিও সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যবিমা নির্ভর করে তার আয়–রোজগার কেমন। একজন ফুলটাইম চাকরিজীবী ৩০ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্তও স্বাস্থ্যবিমা দিয়ে থাকেন। যদিও চিকিৎসাসেবার জন্য হাসপাতাল ও জার্মানির যেকোনো ক্লিনিকের চিকিৎসা সবার জন্যই সমান।
জার্মানিতে আইনি জটিলতায় পড়েছেন? একজন আইনজীবী দরকার! প্রচণ্ড ব্যয়বহুল! আপনাকে পদে পদে হাজার থেকে লাখ টাকা খরচ করতে হবে অথচ একজন শিক্ষার্থী কল্যাণ তহবিলের মাধ্যমে ফ্রি আইনি সেবা পান। ওই যে সেশন চার্জের সঙ্গে এক হাজার টাকা শিক্ষার্থী কল্যাণ তহবিলে দেওয়া হলো। এ সেবাটা ওই টাকার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। ফ্রি আইনি সেবার ব্যাপারটা একটা শিক্ষার্থীর জন্য প্রচণ্ড আশীর্বাদস্বরূপ।
একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যানটিনে একই খাবারে তিন ধরনের খাবার বিল ঠিক করা থাকে—শিক্ষার্থী, শিক্ষক/স্টাফ ও অতিথি। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের খাবারের দাম শিক্ষক বা স্টাফদের থেকে অর্ধেকের কম দাম ধার্য করা থাকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, অতিথিদের একই খাবার ক্যানটিন থেকে দ্বিগুণ দামে কিনে খেতে হয়। চা, কফির ভেন্ডিং মেশিন ও শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের আলাদা করা থাকে। এখানেও শিক্ষার্থীরা অর্ধেক দামে চা, কফি, ড্রিংকস কিনতে পারেন। দুপুরের খাবারে থাকে নানা রকম বৈচিত্র্য। সপ্তাহে পাঁচ কর্মদিবসেই নানা বৈচিত্র্যের খাবার পরিবেশন করা হয় এবং খাবারে এটাও লেবেলিং করা থাকে যে কোন খাবারের পুষ্টিগুণ কেমন।
মোদ্দা কথা, মসৃণ পথের একটি অরাজনৈতিক আবহে মোড়ানো শিক্ষার্থীরা নিজে পারে সৃষ্টিশীল ও সৃজনশীল হতে এবং এরাই পারে দেশকে উন্নত মানের সেবা দিতে, অন্যথায় নয়!
* লেখক: মাহবুব মানিক, গবেষক, মার্সেবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স, হালে, জার্মানি