জবি প্রতিনিধি: জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) বর্তমান রেজিস্ট্রারের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ১৩ জুন। চলতি মেয়াদ শেষে এই চেয়ারে কে বসবেন তা নিয়ে এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা মহলে নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। বিভিন্ন মহল থেকে প্রায় অর্ধ ডজন কর্মকর্তার এই পদে বসা নিয়ে প্রস্তাবনা আসছে। এই পদে বসতে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন জায়গায় তদবিরে ব্যস্ত রয়েছেন একাধিক কর্মকর্তা। আলোচনার পাশাপাশি এসব নাম নিয়ে বিভিন্ন মহলে চলছে সমালোচনাও।
প্রায় ২০ হাজার শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্ট্রার পদটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইতোমধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনের বিভিন্ন প্রকল্প চলমান থাকায় এই পদটি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এমন প্রকল্পে বিভিন্ন সময়ে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে এসব প্রকল্পের দায়িত্ব পান রেজিস্ট্রার। এর ফলে পদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। তাই এই পদে বসা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় অর্ধ ডজন কর্মকর্তা ও শিক্ষক তদবিরের জন্য দৌঁড়ঝাপ শুরু করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক, কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বর্তমান রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী মো. ওহিদুজ্জামানের এই পদে মেয়াদ বৃদ্ধি বা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সম্ভাবনা অনেকটাই কম। বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে বর্তমান রেজিস্ট্রারের নাম পাঠানোয় নতুন কাউকে নিয়োগ দেওয়া হবে বলেই মনে করছেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষক সমিতির নেতারা রেজিস্ট্রার হিসেবে একজন শিক্ষককে চাইলেও নীলদলের একটি অংশ কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে রেজিস্ট্রার হিসেবে চাচ্ছেন।
এই পদের জন্য রেজিস্ট্রার দপ্তরের ডেপুটি রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ জাহিদ আলম, ডেপুটি রেজিস্ট্রার জিয়াদুর রহমান, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল কাদেরের নাম জোরেসোরে শুনা যাচ্ছে। এছাড়া আরও কয়েকজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক ও কর্মকর্তাও এই পদে বসতে তদবিরের ব্যস্ত রয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. কামালউদ্দীন আহমদকেও রেজিস্ট্রার হিসেবে দেখতে চাইছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের একটি অংশ।
আলোচনায় থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে রেজিস্ট্রার দপ্তরে সংস্থাপন (কর্মকর্তা) শাখায় কর্মরত ডেপুটি রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ জাহিদ আলমের নাম রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগে সবচেয়ে বেশি জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে। তিনিই পরবর্তী রেজিস্ট্রারের পদে বসতে পারেন বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে। তবে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়মসহ বিভিন্ন অভিযোগও রয়েছে। তার নিয়োগ প্রক্রিয়া ও পদোন্নতি অবৈধ বলেও অভিযোগ রয়েছে। এনিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি অভিযোগও জমা পড়েছিল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৮ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে জনসংযোগ কর্মকর্তা পদে (৯ম গ্রেড) চাকরির জন্য আবেন করেন মো. জাহিদ আলম। তৎকালীন উপাচার্য সিরাজুল ইসলাম তাকে সহকারী রেজিস্ট্রারের সমপদ (৭ম গ্রেড) পিস টু ভিসি পদে নিয়োগ দেন। সরকারি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধান অনুযায়ী ৭ম গ্রেডে নিয়োগ লাভের জন্য সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে প্রথম শ্রেণি (৯ম গ্রেড) কর্মকর্তা পদে ৫ বছরের অভিজ্ঞতা আবশ্যক থাকলেও তিনি শূন্য অভিজ্ঞতায় নিয়োগ পান। এক দিনের অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও জনসংযোগ কর্মকর্তা (৯ম গ্রেড) পদে আবেদন করে নিয়মের বাইরে গিয়ে ৭ম গ্রেডের পিস টু ভিসি পদে নিয়োগ বাগিয়ে নেন। যার ফলে জাতীয় বেতন স্কেলের গেজেট ২০০৫ এর ১০ ধারা শর্ত লঙ্ঘন হয়। জাতীয় বেতন স্কেল ২০০৫ এর ১০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ৭ম গ্রেডের পূর্ণ বেতন পাওয়ার জন্য নূন্যতম চাকুরির অভিজ্ঞতা ৪ বছর থাকার কথা হলেও তার কোনো অভিজ্ঞতা ছিলো না৷ পরবর্তীতে ২০১১ সালের ১৭ জুলাই প্রভাব খাটিয়ে সিলেকশন গ্রেড হিসেবে ৬ষ্ঠ গ্রেড লাভ করে। ৬ষ্ঠ গ্রেডে পূর্ণ বেতন পাওয়ার প্রয়োজনীয় নূন্যতম চাকরির অভিজ্ঞতা ৫ বছর প্রয়োজন হলেও তার অভিজ্ঞতার ঘাটতি ছিলো ১ বছর। যা জাতীয় স্কেল ২০০৯ এর ১০ ধারা লঙ্ঘন করে।
২০১২ সালের ৩০ মে তিনি ৫ম গ্রেডে ডেপুটি রেজিস্ট্রার (উপসচিব পদমর্যাদার) পদে নিয়োগ লাভ করে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সার্ভিস রুলস ও জাতীয় বেতন স্কেল ২০০৯ এর ১০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এ পদে নিয়োগ লাভ করতে হলে প্রথম শ্রেণির (৬ষ্ঠ থেকে ৯ম গ্রেড) কর্মকর্তা পদে ১০ বছরের অভিজ্ঞতার বিধান থাকলেও জাহিদ আলমের অভিজ্ঞতা ছিলো মাত্র ৫ বছর। এক্ষেত্রে ৫ বছরের অভিজ্ঞতার ঘাটতি নিয়েই তিনি ডেপুটি রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ পান।
এরপর ২০১৪ সালের ৩১ মে তিনি ৪র্থ গ্রেডে পদোন্নতি পান। এক্ষেত্রেও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মানুযায়ী কর্মকর্তা পদে ১৮ বছর ও জাতীয় বেতন স্কেল ২০০৯ এর ১৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ১২ বছর চাকরির অভিজ্ঞতার বিধান থাকলেও তার ছিলো মাত্র ৭ বছর। তার নিয়োগ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও বেতন ভাতাদি ও অন্যান্য ভাতা বাবদ লক্ষ্যাধিক টাকা গ্রহণ করা সরকারের সম্পদ অপচয় করার সামিল বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ ঘটনায় পরবর্তীতে ২০১৮ সালের ৬ জুলাই দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জাহিদ আলমের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগও জমা পড়ে। একই বছরের ১৮ নভেম্বর দুদকের মহাপরিচালক (বিশেষ তদন্ত) খান মো. নুরুল আমিন স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে তদন্তপূর্বক একটি প্রতিবেদন চাওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেই চিঠির জবাব দিলেও পরবর্তীতে আর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
অন্যদিকে রেজিস্ট্রার দপ্তরের সংস্থাপন (কর্মচারী) শাখার ডেপুটি রেজিস্ট্রার জিয়াদুর রহমানও রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগের জন্য আছেন আলোচনায়। তিনিও নিয়োগ পেতে পারেন বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে। তবে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও রয়েছে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ।
২০২২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে ৬ জন কর্মচারী নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ উঠে জিয়াদুর রহমানের বিরুদ্ধে। এঘটনায় তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়। যার তদন্ত কার্যক্রম এখনও চলমান রয়েছে বলে জানা গেছে।
এর আগেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি বিজ্ঞপ্তিতে ভুল করেন জিয়াদুর রহমান। সেই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়কে ১ লক্ষ টাকা গচ্ছা দিতে হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। সেই ঘটনায় তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান মৌখিকভাবে তাকে ওএসডি অথবা বদলির নির্দেশ দিলেও পরবর্তীতে প্রভাবশালী শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের তদবিরে তিনি বেঁচে যান।
এদিকে শিক্ষকদের মধ্য থেকেও রেজিস্ট্রার নিয়োগের দাবি উঠেছে। এই তালিকায় আছেন বর্তমান কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. কামালউদ্দীন আহমেদের নামও। শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের একটি অংশ কামালউদ্দীন আহমদকে কোষাধ্যক্ষ হিসেবে চাচ্ছেন। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ডেপুটি রেজিস্ট্রার ও বর্তমানে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর এর রেজিস্ট্রার সৈয়দ ফারুক হোসেনও আছেন আলোচনায়। তিনিও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্ট্রার পদে ফিরতে চাচ্ছেন বলে আলোচনা হচ্ছে।
এদিকে শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তীকালীন একজন শিক্ষককে রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগের দাবি উঠেছে। সৎ ও দক্ষ একজনকে রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগের দাবি জানিয়ে উপাচার্যের সাথে সাক্ষাতও করেছে শিক্ষক সমিতির নেতারা।
এবিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম মো. লুৎফর রহমান বলেন, ‘আমরা চাই সৎ ও দক্ষ একজন এই পদে আসুক। সেই কথা আমরা উপাচার্য মহোদয়কেও জানিয়েছি। দক্ষ একজনকে নিয়োগের আগে অন্তর্বর্তীকালীন দায়িত্বে একজন শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া যায় কিনা সেই বিষয়ে আমরা আমাদের মতামত জানিয়েছি। কর্মকর্তার মধ্য থেকেও যদি আসে সেক্ষেত্রেও দক্ষ ও সৎ একজন যাতে আসে আমরা সেটাই চাই। তবে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে যাতে কাউকে দায়িত্ব দেওয়া না হয় আমরা সেই দাবি জানিয়েছি।’
এবিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. ইমদাদুল হক বলেন, ‘এখনও এটা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি৷ প্রশাসনিকভাবে পরে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’