ববি প্রতিনধিঃ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস পথের পাঁচালীর অপু আর দুর্গার কথা মনে আছে তো? ‘অপু বলিল, কি ফুলের গন্ধ বেরুচ্ছে, না দিদি? তাহাদের মা বলিল, তাহাদের জ্যেঠামশায়ের ভিটার পিছনে ছাতিম গাছ আছে, সেই ফুলের গন্ধ। তাহার পর সকলে গিয়া ঘুমাইয়া পড়ে। রাত্রি গভীর হয়। ছাতিম ফুলের উগ্র সুবাসে হেমন্তের আঁচলাগা শিশিরাদ্র নৈশবায়ু ভরিয়া যায়। মধ্যরাতে বেনুবনশীর্ষে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের ম্লান জ্যোৎস্না উঠিয়া শিশিরসিক্ত গাছপালার ডালে পাতায় চিকচিক করছে।’
দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম বিদ্যাপীঠ বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনের পিচঢালা রাস্তায় ঝাঁকড়া পত্রপলস্নবের মাঝে দাঁড়িয়ে ক্যাম্পাসের প্রকৃতিতে সুঘ্রাণ বিলাচ্ছে ছাতিম গাছ। অনেকের কাছে ক্যাম্পাসের এই জায়গাটি ‘ছাতিম চত্বর’ নামেও পরিচিত।
শীতের আগে প্রকৃতিতে সাধারণত কোন ফুল ফুটতে দেখা যায় না। প্রকৃতিতে যখন কিছুটা ফুল শূণ্যতা বিরাজ করে তখন ফোটে ছাতিম। হেমন্তের গোধূলি লগ্ন থেকে রাত অবধি মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে প্রকৃতিকে মাতিয়ে রাখে ছাতিম। বাতাসে ছাতিমের সুবাস অন্য ধরনের মাদকতা ছড়ায় হৃদয়ে। বুনো ফুল ছাতিমের মিষ্টি ঘ্রাণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণবন্ত ক্যাম্পাসে, ছাতিম ফুলের গাছটি শুধু একটি সৌন্দর্য নয়; এটি বন্ধুত্ব, ভালোবাসা ও স্মৃতির প্রতীক। বহু শিক্ষার্থী এখানে আড্ডা দেয়, প্রেমের কথা বলে।
দিনের রোদে কখনো ছাতা হয়ে ছায়া দেয়, আবার সন্ধ্যা নামলেই গল্প আর চায়ের আড্ডায় মেতে থাকা শিক্ষার্থী কিংবা দর্শনার্থীদের মোহনীয় গন্ধে বিমুগ্ধ করে তোলে ছাতিম চত্বরের এই মায়াবী সুঘ্রাণের বৃক্ষ। পথিকের দৃষ্টি কাড়তে বাধ্য চিরসবুজ দুধকষভরা নয়নাভিরাম এই সাদা ফুলের বৃক্ষ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ শিক্ষার্থী ফাতেমা তুজ জোহরা জানায়,প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় । দপদপিয়া ব্রিজের শেষপ্রান্তে আসতেই দেখা মেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাল দালানগুলো । সেই সাথে বর্তমানে নজর কাড়ছে রাস্তার ওপারে থাকা ছাতিম গাছ । সারা গাছ জুড়ে থোকায় থোকায় সাতটি পাতার মাঝে ফুটে থাকা এই ছাতিম ফুল সকলের নজর কাড়তে বাধ্য । দিনের বেলা এই ছাতিম গাছটাকে দেখতে অত্যন্ত স্নিগ্ধ লাগে আবার রাতে উজ্জ্বল এক রূপ ধারণ করে গাছটি । এই ফুল শুধু যে দেখতেই সুন্দর তা নয়, এর রয়েছে অসাধারণ এক সুগন্ধ । এ যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মুখে এক বাড়তি সৌন্দর্যের ধারক । বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীদেরকে এই ছাতিমতলায় বসে আড্ডা দিতে দেখা যায় । অনেকে ছাতিমতলার সৌন্দর্য ধারণ করে রাখছে ফটোসেশানের মাধ্যমে । তবে দুঃখের বিষয় এই জায়গাটাতে অনেক সময় ময়লা-আবর্জনার স্তূপ থাকতে দেখা যায় । তাই সকলের উচিত নিজ নিজ জায়গা থেকে পরিবেশ পরিছন্ন রাখার চেষ্টা করা ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আলিবুদ্দিন জানায়, ছাতিমফুল এর সৌন্দর্য অপরূপ। ছাতিমফুল শুধু সৌন্দর্য বর্ধন করে না, এটি পরিবেশের জন্যও উপকারী। এটি পরিবেশকে শুদ্ধ রাখতে সাহায্য করে। ছাতিম ফুল বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। বরিশালের সবুজ প্রান্তরের সাথে ছাতিম ফুলের সাদা, সুঘ্রাণযুক্ত ফুলগুলো শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। ছাতিম গাছের এই ফুলগুলো শুধু যে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে নান্দনিকভাবে সমৃদ্ধ করে তা নয়, বরং এর সৌন্দর্য ও মনোরম সুবাস শিক্ষার্থীদের মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়। ঋতু পরিবর্তনের সাথে ছাতিম ফুলের উপস্থিতি যেন প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের এক অনন্য দৃষ্টান্ত, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশকে আরও মনোমুগ্ধকর করে তোলে।
উল্লেখ্য, ছাতিমের বৈজ্ঞানিক নাম Alstonia scholaris। পড়ালেখার সঙ্গে যোগ আছে বলে দ্বিতীয় অংশের এমন নামকরণ। একসময় এর কাঠ দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ড ও ছাত্রদের লেখার শ্লেট তৈরি করা হতো। ছাতিম গাছের বাকল বা ছাল শুকিয়ে নিয়ে ওষুধের কাজে ব্যবহার করা হয়। দীর্ঘস্থায়ী অতিসার এবং আমাশয়ে এটি অত্যন্ত উপকরী। ছাতিমগাছ নিয়ে আছে নানা উপকথা ও কিংবদন্তি। বিভিন্ন অঞ্চলে আদিবাসীরা এর তলায় বসতে বা এর ছায়া মাড়াতে চায় না। ছাতিমগাছের সঙ্গে শয়তানের যোগসূত্র আছে বলে অনেকের বিশ্বাস; তাই ইংরেজি নাম ডেভিলস ট্রি।