গল্প: কাদম্বিনীর কান্না
রুহানা আক্তার বৃষ্টি
মেঘাকে বাড়িতে একা রেখে সবাই বিয়ের অনুষ্ঠানে চলে গেল। মেঘা একা একা বারান্দায় দাড়িয়ে আছে, চোখে তার জল। তার এইটুকু জীবনের বেশিরভাগ সময় কান্নার মাঝে কেটেছে। অতিরিক্ত কান্নার ফলে তার চোখে মাঝে মধ্যে খুব সমস্যা হয়, যন্ত্রনা হয়। দূরের কোনো জিনিস তার কাছে অস্পষ্ট লাগে। কিন্তু কাউকে সে বলতে পারে না। আর বলবেই বা কি করে? কারণ সে বাকপ্রতিবন্ধী। হয়তো এটাই তার নিয়তি, যেখানে শুধু দুঃখ আর কান্না এই দুটি শব্দ লেখা আছে।
হঠাৎ আকশে বজ্র চমকায়, ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। একটা সময় মুশলধারায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করে। মেঘার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ভিজতে। সে জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো স্পর্শ করছে। কিন্তু সে ভিজবে কি করে? সে তো এক কারারূপি ঘরে বন্দী। মেঘা মনে মনে বলে, ” মুক্ত আকাশের নিচে নীল ছোঁয়া প্রকৃতি, নেই বাধারূপি ঐ চার দেয়ালি খাঁচাটি। বন্দী দশার ময়না পাখিটা মুক্ত হতে চায়, ঐ খোলা আকাশে আপন মনে উড়ে যেতে চায়। মেঘার সবচেয়ে কাছের বন্ধু হচ্ছে একটা ময়না পাখি। এই পাখিটার সাথে তার অনেক মিল। পাখিটা যেমন খাঁচায় বন্দী তেমনি মেঘাও কারারূপি ঘরে বন্দী। পাখিটা যেমন মুক্ত হতে চায় খাঁচা থেকে তেমনি মেঘারও খুব ইচ্ছে হয় খোলা আকাশের নিচে বৃষ্টিতে ভিজতে। নিজের ঘরটাকে মেঘার কাছে কারাগারের একটা কক্ষ মনে হয়। আর বাড়িটাকে পুরো কারাগার মনে হয়। কারণ এখানে সে নিজের মতো করে চলতে পারে না, সবসময় ছোট মায়ের হুকুম মতো চলতে হয়, প্রতিদিন বাড়ির অনেক কাজকর্ম তাকে করতে হয়। শুধুমাত্র বিকেল বেলা সে তার বন্ধু ময়না পাখির সাথে একটু সময় কাটাতে পারে।
বাবা যেদিন অস্ট্রেলিয়া চলে যান, ঠিক তার কয়েকমাস পর থেকে মেঘার জীবনে দুঃখ নামক পর্বটি শুরু হয়। যেই পর্বের কোনো সমাপ্তি ছিল না। মেঘার ছয় বছর বয়সে মা না ফেরার দেশে চলে যায়। এর পর থেকে বাবা তাকে মায়ের অভাব বুঝতে না দিয়ে মানুষ করে তোলে। যদিও সে দ্বিতীয় বিয়ে করতে চায়নি, তবুও পরিবারের সকলের অনুরোধে বিশেষ করে তার মায়ের অনুরোধে তাকে বাধ্য হয়ে বিয়েটা করতে হয়। এখন মেঘার মেঘার বয়স ১৩ বছর সে অনেক কিছুই জানে বোঝে, শুধুমাত্র প্রকাশের মাধ্যম তার নেই। এখন মেঘা একটি আশা নিয়ে আছে ৩ বছর পর বাবা দেশে ফিরবে তখন সবকিছু ঠিক আগের মতো হয়ে যাবে। বাবা মেঘাকে গল্প শোনাবে, রাতে ঘুম পাড়িয়ে দেবে, খাবার খায়িয়ে দেবে। বাবা ফিরলে ছোট মা আর তার সাথে খারাপ আচরণ করতে পারবে না।
মেঘার মনে যখন কষ্ট জমে পাহাড় গড়ে, সে কষ্টের বহিঃপ্রকাশে মেঘের মতো করে আর্তনাদ করতে পারে না। কারণ বিধাতা তাকে বাকশক্তি দান করেন নি। তবে বৃষ্টির মতো করে তার কান্না ঝর্না ধারায় ঝড়ে। সে চিৎকার করে কাঁদতে চায় কিন্তু পারে না।
মেঘা মনে মনে বলে, বাবা যেদিন আসবে সেদিন সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। মেঘা কাগজে লিখে লিখে বাবাকে সবকিছু জানাবে।
একদিন রান্না করতে গিয়ে মেঘার হাত পুড়ে যায়। পোড়া ক্ষতের যে কি যন্ত্রনা, যে আঘাত পায় একমাত্র সেই বোঝে। হাত পুড়ে গেছে এটা সে কাউকে যানায়নি। পোড়া হাত নিয়ে বাকি কাজগুলো শেষ করে। কাজ শেষে মেঘা টেবিলে সবার জন্য খাবার সাজায়। মেঘা খাবার ঘর থেকে চলে যাবার সময় ছোট মা ডাক দিল। বললেন, মেঘা আমাদের খাওয়া শেষ হলে তুমি খেয়ে নিও। তরপর সবকিছু গুছিয়ে ঘুমোতে যাবে।
মেঘা বলল, ঠিক আছে।
হঠাৎ তার হাতে যন্ত্রনা শুরু হয়। যখন পুড়ে গিয়েছিল তখন অতটা সে খেয়াল করেনি। মেঘা কিছুক্ষণ ঠাণ্ডা পানিতে হাতটা ভিজিয়ে রাখল। রাতের খাওয়া আর হলো না। মেঘা নিজের ঘরে চলে যায়। সে ঘুমোতে চেষ্টা করল কিন্তু যন্ত্রনায় ঘুম আসছে না। মেঘা মনে মনে বলে, আজ যদি মা থাকত তাহলে আমার হাতে মলম লাগিয়ে দিত, আমাকে কষ্ট করতে দিত না। যদি বাবা পাশে থাকত, তাহলে নিজ হাতে খায়িয়ে দিত, ঘুম পাড়িয়ে দিত, গল্প শোনাতো।
মেঘা এসব ভাবতে ভাবতে বারান্দায় গিয়ে ময়না পাখিটার সামনে অনেকক্ষণ কান্না করে। মাকে তার খুব মনে পড়ছে।
মেঘা আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে,মা আজ আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। তোমার আর বাবার কথা মনে পড়ছে। তুমি তো আমায় একলা রেখে চলে গেছো আর বাবা তুমি কবে আসবে? আমাকে এখানে কেউ ভালোবাসে না যতটা তোমরা ভালোবাসো। মা আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও।
কিছুক্ষণ পর মেঘা ঘরে চলে আসে। কাঁদতে কাঁদতে সে ঘুমিয়ে যায়। ঘুমের মধ্যে সে স্বপ্নে দেখে, খুব সুন্দর এক ফুলের বাগান। বিচিত্র রকম ফুলের গাছ, লাল- নীল প্রজাপতি উড়ছে। মেঘা তাদের পিছু পিছু ছুটছে….. প্রজাপতির পিছু ছুটতে গিয়ে সে একটা জায়গায় এসে পৌছাল। সেখানে মেঘা তার মাকে দেখতে পায়। দৌড়ে সে তার মায়ের কাছে চলে গেল।
এই স্বপ্নের মধ্য দিয়ে মেঘা সত্যিই তার মায়ের কাছে চলে গেছে। অর্থাৎ না ফেরার দেশে।
আমাদের পরিবারে, সমাজে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের মধ্যে কেউ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, কেউবা বাকপ্রতিবন্ধী, আবার কারো বুদ্ধিমত্তা কম, কারো বা দেহের একটা বিশেষ অঙ্গহানি হয়েছে। এদের প্রতি পরিবারের অন্য সদস্যদের যত্নবান হওয়া প্রয়োজন, এদের সঙ্গ দিতে হবে, গল্প করতে হবে, ভালো আচরণ করতে হবে যাতে করে এরা নিষঙ্গতায় না ভোগে বা নিজেদের যেন ছোট মনে না করে। এ দায়িত্ব যেমন পরিবারের তেমনি সমাজে বসবাসরত সকলের। এই শিশুরা বিশেষ কোনো একটা বিষয়ে পারদর্শী হয়, এদেরও সুপ্ত প্রতিভা রয়েছে। সেই দিকটা খুঁজে বের করতে হবে এবং এদের উৎসাহ দিতে হবে। এরা যেন আত্মনির্ভরশীল হতে পারে।
শিক্ষার্থী, লোকপ্রসাশন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।