দুর্নীতি দমন কমিশনের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সংস্থাটির শীর্ষ এক কর্মকর্তা ধরা পড়ছেন বলে জানা যাচ্ছে। তিনি হলেন সদ্য পদত্যাগ করা কমিশনার মো. জহুরুল হক। এরই মধ্যে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বেশুমার দুর্নীতি, অনিয়ম, সরকারি প্লট জালিয়াতি, ক্ষমতার ভয়াবহ অপব্যবহার ও সরকারি গাড়ি ড্রাইভারসহ ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। শিগগির তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান দল গঠন করবে কমিশন। এমনটাই জানা যাচ্ছে।
গতকাল কমিশন সভায় তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের বিষয়ে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। দুদকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা গণদমাধ্যমকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
ওই কর্মকর্তা বলেন, সাবেক কমিশনার জহুরুল হকের বিরুদ্ধে দুদকে যে অভিযোগ জমা হয়েছে, সেটি অত্যন্ত কনক্রিট অভিযোগ। তাই তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, জহুরুল হক বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান ছিলেন। ওই সময় তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশনের তরঙ্গ বরাদ্দে জালিয়াতি, ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানিকে তার অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার বিষয়টিও বহু পুরোনো। সাবেক মহানগর দায়রা জজ জহুরুল হক গত ২৯ অক্টোবর দুদক কমিশনারের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ২০২১ সালের ২ মার্চ তিনি দুদক কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন।
এদিকে জহুরুল হকের পাসপোর্ট বাতিল করে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষাসেবা বিভাগ। মঙ্গলবার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. কামরুজ্জামান স্বাক্ষরিত ওই চিঠি ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক বরাবর পাঠানো হয়।
চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ পাসপোর্ট অর্ডার, ১৯৭৩-এর ৭(২) (সি) নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নিম্নোক্ত ছকে বর্ণিত ব্যক্তির পাসপোর্ট বাতিলপূর্বক তিনি যাতে দেশত্যাগ করতে না পারেন, সে বিষয়ে পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
চিঠিতে জহুরুল হকের নামপরিচয়, ঠিকানা, বাবার নাম, ন্যাশনাল আইডি নম্বর ও পাসপোর্ট নম্বর দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, বিডিআর হত্যা মামলার বিচারক ছিলেন মো. জহুরুল হক। বিডিআর হত্যা মামলার রায় নিয়ে একটি পক্ষ অসন্তুষ্ট। তাদের দাবি, পতিত সরকার আদালতের বিচারকদের প্রভাবিত করে মামলায় পক্ষপাতমূলক রায় করিয়েছে। এরই মধ্যে বিডিআর হত্যা পুনর্তদন্তে নতুন করে কমিশন গঠন করেছে সরকার। এ কারণে তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, দুদক কমিশনার (তদন্ত) হিসেবে জহুরুল হক দায়িত্ব নেওয়ার দেড় বছরে ২০২২ সালের ২৩ আগস্ট তার নিজের নামে বরাদ্দ দেওয়া পাঁচ কাঠার প্লটের পরিবর্তে ১০ কাঠা আয়তনের প্লট দিতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেন। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ৩ নভেম্বর গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে রাজউক চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে জহিরুল হকের পাঁচ কাঠা ও তার স্ত্রী মাছুদা বেগমের নামে থাকা পাঁচ কাঠার প্লট দুটি সমর্পণ সাপেক্ষে একটি ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দ দেওয়ার জন্য বলা হয়।
রাজউকের বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, জহুরুল হককে ১৩/এ ধারায় ২৫ নম্বর সেক্টরের ২০৬ নম্বর সড়কের ১০ কাঠা আয়তনের ৪৭ নম্বর প্লটটি বুঝিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে তিনি বাড়ি নির্মাণে নকশার অনুমোদন নিয়েছেন। আইন অনুযায়ী, স্বামী ও স্ত্রীর নামে আলাদা আলাদা প্লট বরাদ্দ দেওয়া যাবে না। কোনো প্রকল্পে স্বামী ও স্ত্রীর নামে আলাদা প্লট বরাদ্দ পেলে একটি প্লট বহাল রেখে আরেকটি সমর্পণ করতে হবে। স্বামী-স্ত্রী আলাদা প্লট বরাদ্দ নিলে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার বিধান রয়েছে। কিন্তু জহুরুল হক ও তার স্ত্রী মাছুদা বেগম আলাদা আলাদা প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন। অথচ তারা একটি প্লট সমর্পণ করেননি, রাজউকও তাদের একটি প্লটের বরাদ্দ বাতিল করেনি। উল্টো জহুরুল হক দুদক কমিশনার হিসেবে প্রভাব খাটিয়ে ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন।
এ ছাড়া দুদক কমিশনার হিসেবে জহুরুল হকের নিজের জন্য একটি গাড়ি বরাদ্দ ছিল। কিন্তু বরাদ্দকৃত গাড়ির বাইরে স্ত্রী ও সন্তানদের সার্বক্ষণিক ব্যবহারের জন্য চালকসহ তিনি বেআইনিভাবে জন্য আরও একটি গাড়ি বরাদ্দ নেন। জহুরুল হকের একান্ত সচিব চালকসহ গাড়ি বরাদ্দে দুদকে আবেদন করেন। সেই আবেদনে তিনি বলেছিলেন, জহুরুল হক ধানমন্ডির সরকারি বাংলোতে বাস করেন। তিনি তার অনুকূলে চালকসহ অতিরিক্ত আরেকটি গাড়ি বরাদ্দ চান। গাড়ি ব্যবহার বাবদ সরকারি ফি তিনি পরিশোধ করবেন। তার বাসভবনে চালকের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গাড়ি বরাদ্দ দিয়ে দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে চিঠি ইস্যু করা হয়।
সেই চিঠিতে বলা হয়, কমিশনার জহুরুল হকের ইচ্ছা অনুযায়ী চালক সাদ্দাম হোসেন ও ঢাকা মেট্রো-গ৪২-৭৬৩০ গাড়িটি সার্বক্ষণিক ব্যবহার করার জন্য অনুমতি দেওয়া হলো। বিষয়টি নিয়ে দুদকের ভেতরে অনেকের মধ্যে ক্ষোভ ছিল। কারণ সংস্থাটিতে গাড়ির চরম সংকট রয়েছে। উপপরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তারা শেয়ার করে গাড়ি ব্যবহার করেন।