মাভাবিপ্রবি প্রতিনিধি: ১লা জুলাই থেকে শুরু হওয়া কোটা-সংস্কার আন্দোলন ধীরে ধীরে রূপ নেয় সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে। ৩৬ দিনের এই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের উপর বয়ে যায় এক পৈশাচিক নির্যাতনের ঢেউ।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোটা-সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেয় ৫ জুলাই থেকে। আন্দোলনে অংশ নেওয়ার পরে থেকেই তাদের উপর শুরু হয় দমন-পীড়নসহ নানারকম অত্যাচার। ছাত্রলীগ কর্তৃক শুরু হতে থাকে হুমকি ধামকি, মানসিক ও শারীরিক হয়রানির। আর ছাত্রলীগের এই অপকর্মের বৈধতা দিতে মাভাবিপ্রবি প্রক্টরিয়াল বডি। ছাত্রলীগ একে একে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ধরে নিয়ে যেত প্রক্টর অফিসে। প্রক্টর অফিসের ভিতরেই প্রক্টরিয়াল বডির সামনে মারধর, গালিগালাজ,হুমকি-ধামকি, মিথ্যা মুচলেকাসহ নানারকম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হত আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের। আর সেখানে উপস্থিত প্রশাসন ও শিক্ষকরা নীরব ভূমিকা পালন করে এই অমানসিক কার্যক্রমের বৈধতা দিতেন।
গত ১০ই জুলাই ঠিক এমনই এক কালোদিন ছিল অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী সাংবাদিক মো.জাহিদ হোসেনের। মাভাবিপ্রবির কোটা-সংস্কার আন্দোলন পরিচালনা, প্রচার-প্রচারণাসহ নানাভাবে ভূমিকা রাখছিলেন তিনি। আন্দোলন বন্ধ ও তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য একটি নাটক সাজিয়ে প্রক্টর অফিসে তাকে জিম্মি করে নানারকম ভয়ভীতি দেখিয়ে জোরপূর্বক একটি মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মুছলেকা নেওয়া হয়। ছাত্রলীগ সভাপতি মানিক শীল ও তৎকালীন প্রক্টর অধ্যাপক ড. মুছা মিয়ার তত্ত্বাবধানে এই মুছলেকা নেওয়া হয়। পরবর্তীতে তাকে হামলা-মামলার ভয় দেখিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
গত ১২ই জুলাই আরেকটি নিষ্ঠুরতম প্রহসনের স্বীকার হন হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নাজমুল হাসান ভূঁইয়া ও বিজিই বিভাগের শিক্ষার্থী মোবাসসিরুল ইসলাম শাকিলের সাথে। “তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার” এই ভিডিও তৈরি ও শেয়ার দেওয়ার কারণে তাদের হল ও মেসে থেকে তুলে এনে মারধর করতে করতে প্রক্টর অফিসে নিয়ে যায় ছাত্রলীগ। সেখানেও প্রক্টরিয়াল বডি সবার সামনে তাদের মারতে থাকে ছাত্রলীগ। উপস্থিত শিক্ষকরা সবাই নীরব থেকে সমর্থন দেন। তাদেরকেও ভয়ভীতি দেখিয়ে মুছলেকা নেওয়া হয়।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী শাকিল জানান, ওনাদের থেকে ছাত্রলীগ আরও অনুমতি চাইতেছিল আমাদেরকে বাইরে নিয়ে দশ মিনিট বুঝিয়ে আনার জন্য। একটা ম্যাম বলছিল “তোমরা কেন নিয়ে যাবে বিচার করলে আমরা করব। আর বাকিদের নীরবতা দেখে মনে হয়েছিল অনুমতি দিবে। বুঝে উঠতে পারি নাই কে কে মারছিল। এদিকে স্যাররা প্রশ্ন করতেছে আর ওদিকে ওরা মারতেছে। পিটে মাথায় থাপড়াচ্ছে,হাঁটার সময় সামনে পা দিয়ে রাখতেছে ,গলা ধরে ধাক্কাচ্ছে।
সেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রক্টর অধ্যাপক ড. মুছা মিয়া, সহকারী প্রক্টর শাকিল মাহমুদ শাওন, শিক্ষার্থী কল্যাণ পরামর্শ কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক ড. শাহীন উদ্দিন সহ অনেক শিক্ষক।
ওই ঘটনার আরেক ভুক্তভোগী নাজমুল হাসান ভূঁইয়া জানান, “আমাকে মারধর করে আমার মোবাইল আটকিয়ে রাখা হয়েছিল প্রক্টর অফিসে। পরেরদিন সারাদিন বসে থেকে মোবাইল উদ্ধার করতে হয়েছে। আমাকে এমনভাবে মারা হয়েছিল আমি চোখে দেখতেছিলাম না।”
এইরকম আরো অনেক শিক্ষার্থীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয় প্রক্টর অফিসে।
এছাড়া মিছিল থেকে শিক্ষার্থী তুলে নিয়ে প্রক্টর অফিসে আটকিয়ে রাখা, শিক্ষার্থীদের পুলিশের হুমকি দিয়ে হল থেকে বের করে দেওয়া, হাতে থেকে মোবাইল কেড়ে নেওয়া, শিক্ষার্থীর কলার ধরা, নিজ তত্ত্বাবধানে ছাত্রলীগ দিয়ে শিক্ষার্থী মারধর ও হেনস্থা করা, বিচার চাইতে গেলে তা নাকচ করে দেওয়া, প্রক্টর অফিসে ছাত্রলীগের সাথে দিনব্যাপী খোশগল্প, কোটা-সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থী বিরুদ্ধে অবস্থান ও অসহযোগীতামূলক আচরণ, ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকলেও ছাত্রলীগ প্রবেশ করানো, গোয়েন্দা সংস্থা ও মামলার খাতায় শিক্ষার্থীদের নাম ঢুকিয়ে দেয়াসহ হাজারো অভিযোগ উঠেছে তৎকালীন প্রক্টরিয়াল বডির বিরুদ্ধে।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে একটি আতংকের নাম ছিল প্রক্টর অফিস ও প্রক্টরিয়াল বডি।