The Rising Campus
Education, Scholarship, Job, Campus and Youth
রবিবার, ২৭শে অক্টোবর, ২০২৪

কৃষকদের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন জরুরি

নাইমুর রহমান: বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতার বা পরাজয়ের গল্পটি মনে হয় বাংলাদেশের কৃষক ও বাজার ব্যবস্থা নিয়েই রচিত হয়েছিল। নৃত্য পণ্যের দাম যেমন বেড়েছে লাগামহীনভাবে তেমনি কৃষকদের হতাশা বেড়েছে ন্যায্য মূল্যে ফসল বিক্রি করতে না পারায়। প্রতিটি জায়গাতে সিন্ডিকেট বেড়ে যাওয়াই নানামুখী সমস্যার মধ্যে পড়তে হয় নিম্ন আয়ের মানুষদের । বাংলার মানুষ দুবেলা দুমুঠো ভাত খেতে চায়। বাংলাদেশে আনুমানিক এক কোটি ৬৫ লাখ থেকে দুই কোটি কৃষক পরিবার তাদের সামাজিক মর্যাদা চায়, রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণ করতে চায়।

যে বৈষম্যর বিরুদ্ধে বাংলাদেশে অসংখ্য অগণিত আন্দোলন হয়েছে এবং এই আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে আমরা ১৯৭১ সালে আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি। সর্বশেষ, ২০২৪ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মূলমন্ত্রই ছিল বাংলাদেশে কোন প্রকার বৈষম্য থাকবে না এখানে থাকবে সমান অধিকার। প্রতিষ্ঠিত হবে সাম্য প্রত্যেকে তার যোগ্যতা অনুযায়ী অধিকার ভোগ করবে, শাসকরা জনগণের কথা বলবে এবং জনগণের পাশে দাঁড়াবে কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি যে বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি কৃষি খাতে ৫০ ভাগ মানুষ যুক্ত হলেও তাদের আর্থসামাজিক তেমন কোনো উন্নতি নেই।

বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে। কিন্তু বাঙালি কৃষকের অসহায় ও দরিদ্র জীবনের কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে নি। বাংলার কৃষক আজো শিক্ষাহীন, বস্ত্রহীন, চিকিৎসাহীন জীবন-যাপন করছে। দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে, কমেছে কৃষি জমির পরিমাণ। এ ছাড়া অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বন্যা, খরা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ – কোনো কিছুই মোকাবেলা করার কৌশল ও সামর্থ্য কৃষকের নেই। তাই কৃষকের শোচনীয় অবস্থার পরিবর্তন হয় না। তবুও কৃষকরা বহুকাল ধরে অবহেলিত। বিশেষ করে তাদের সামাজিক মর্যাদা এখনো নিম্নমানের।

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় কৃষকদের জীবনযাপন অনিশ্চিত ও স্থবির হয়ে পড়েছে। দীর্ঘ সময়ের পরিশ্রমের মাধ্যমে উৎপাদিত ফসলের দাম না পেয়ে কৃষকদের এখন পথে বসার উপক্রম। এসব কৃষকদের মধ্যে অনেকেই জড়িয়ে পড়েছেন ঋণের জালে। কেউবা জমি বর্গা নিয়ে জমি চাষ করেছেন। ফসল বিক্রি করে ঋণের কিস্তি দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন ঋণ শোধ তো দূরের কথা সংসার চালানো দুরূহ হয়ে পড়েছে। প্রাচীনকালে এ দেশে জনসংখ্যা ছিল কম, জমি ছিল বেশি। উর্বরা জমিতে প্রচুর ফসল হতো। তখন শতকরা ৮৫ জনই ছিল কৃষক। তাদের গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু আর পুকুর ভরা থাকত মাছে। তাদের জীবন ছিল সুখী ও সমৃদ্ধ। তারপর এলো বর্গীর অত্যাচার, ফিরিঙ্গি-পর্তুগিজ জলদস্যুদের নির্যাতন, ইংরেজদের খাজনা আদায়ের সূর্যাস্ত আইন, শোষণ ও নিপীড়ন। এলো মন্বন্তর, মহামারী। গ্রাম- বাংলা উজাড় হলো। কৃষক নিঃস্ব হয়ে গেল। সম্পদশালী কৃষক পরিণত হলো ভূমিহীন চাষিতে। দারিদ্র্য তাকে কোণঠাসা করল। কৃষকের জীবন হয়ে উঠল বেদনাদায়ক।

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান হওয়ায় কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রমে এ দেশ ভরে ওঠে ফসলের সমারোহে। কৃষকের উৎপাদিত ফসল বিদেশে রফতানি করে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয়। বলতে গেলে, কৃষকই আমাদের জাতীয় উন্নয়নের চাবিকাঠি; আমাদের জাতির প্রাণ। কবির ভাষায় :
সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা,
দেশ মাতারই মুক্তিকামী, দেশের সে যে আশা।

গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরুর যে মিথ ঐতিহাসিক কোনো কালপর্বেই তার নজির খুব একটা পাওয়া যায় না। বরং চর্যাপদের ‘হাড়ীত ভাত নাহিঁ নিতি আবেশী’ কিংবা অন্নদা মঙ্গলের ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’—এ আকুতিই শোনা যায় শতাব্দীর পর শতাব্দীতে। কিন্তু এই কৃষকের উৎপাদিত ফসলের উদ্বৃত্ত নিয়েই পাল, সেন, খিলজি, মোগলদের শানশওকত গড়ে উঠেছিল। কৃষকের এ দুর্দশা স্থায়ী রূপ পেয়েছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রভুদের হাতে চালু হওয়া চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে। এর ফলে ব্রিটিশ শাসক ও বাংলার কৃষকদের মাঝে কয়েক স্তরের মধ্যস্বত্বভোগী তৈরি হয়েছিল। ব্রিটিশ প্রভু, জমিদার, জোতদার, নায়েব, বরকন্দাজ সবার ‘খাই’মেটাতে উৎপাদক শ্রেণি কৃষক হয়ে পড়েছিল নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর।

বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে সবখানেই যেন কৃষকেরা হাওয়া হয়ে গেছেন। জাতীয় সংসদে তাঁদের প্রতিনিধি নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর কৃষকদের জন্য আলাদা সংগঠন থাকলেও তাতে কৃষকদের প্রতিনিধিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। ফলে কৃষকের কণ্ঠস্বর কোথাও শোনা যায় না। তরুণ কৃষক সিরাজুলের কাছে তাঁর প্রত্যাশা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানালেন, লাভসহ নিজের উৎপাদিত ফসলের মূল্য চান (সহায়ক দাম)। প্রয়োজনের সময় কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণ চান।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS) কৃষি শুমারি অনুযায়ী , বেশিরভাগ কৃষকের নিজস্ব জমি নেই; তারা অন্যের জমিতে কাজ করেন। সাম্প্রতিক কৃষি শুমারিতে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে ৬০%-এর বেশি কৃষক প্রান্তিক কৃষক বা ভূমিহীন। গ্রামীণ কৃষক পরিবারের আয় তুলনামূলকভাবে কম এবং তারা প্রায়শই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন। দারিদ্র্যের হার কৃষকদের মাঝে বেশি, বিশেষ করে ছোট ও প্রান্তিক কৃষকদের মধ্যে। বেশিরভাগ কৃষক পরিবার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। মৌসুমের ওপর নির্ভরশীলতা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তারা প্রায়শই খাদ্যের ঘাটতির সম্মুখীন হন।

তাই আমাদের কথার সারাংশ হল কৃষকদের আর্থ সামাজিক মান উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে আর দ্বিতীয়ত বাজার ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতে যেন কৃষকরা তাদের নায্য মূল্য পায়। একই সাথে বাজার ব্যবস্থায় বিদ্যমান সিন্ডিকেট কে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং দৈনন্দিন নিত্য প্রয়োজনীয় করতে হবে সহজলভ্য করতে হবে। আর এই দায়িত্ব সরকার সংশ্লিষ্ট সকলকেই নিতে হবে। নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে সকল প্রকার বৈষম্য দূর করতে হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

You might also like
Leave A Reply

Your email address will not be published.