খুবি প্রতিনিধি : আওয়ামী সরকার পতনের পর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) উপাচার্য, উপ- উপাচার্যসহ প্রায় শতাধিক প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা শিক্ষক পদত্যাগে, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। প্রশাসনিক ও আর্থিক দায়িত্ব পালনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষককে দায়িত্ব দেওয়া হলেও গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার না থাকায় স্বাভাবিক কার্যক্রম কার্যত বন্ধ রয়েছে।
ইতোমধ্যে দেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ হলেও দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের শ্রেষ্ট বিদ্যাপীঠে এখনো উপাচার্য নিয়োগ হয়নি। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কে হবেন তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে চলছে আলোচনা। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, উপাচার্য নিয়োগের আলোচনায় এগিয়ে আছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত চার জন শিক্ষক।
আলোচনায় রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও গ্রামীণ পরিকল্পনা ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক (সম্মান) ও বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ থেকে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।
ড. রেজাউল করিম খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের একজন। তিনি বিভিন্ন সময়ে নগর ও গ্রামীণ পরিকল্পনা ডিসিপ্লিনের প্রধান, ডিন, শিক্ষক সমিতির সভাপতি এবং ইনিস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসিউরেন্স সেল (আইকিউএসি)-সহ গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি হাইয়ার এডুকেশন কোয়ালিটি এনহান্সমেন্ট প্রজেক্ট (হেকেপ)-এর অধীনে একটি গবেষণা প্রকল্প সম্পন্ন করেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্বব্যাংক পরিচালিত কলেজ এডুকেশন ডেভলপমেন্ট প্রজেক্ট (সিইডিপি)-এ কনসালটেন্ট হিসেবে যুক্ত ছিলেন। গবেষণার পাশাপাশি আরও কিছু প্রতিষ্ঠানে তিনি কনসালটেন্সি সেবা দিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে উপাচার্য হিসেবে দেখতে চেয়ে অনেক শিক্ষার্থীকে পোস্ট দিতে দেখা গেছে।
পদার্থবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের প্রধান গ্রেড-১ অধ্যাপক ড. মো. হারুনর রশিদ খানের নামও উপাচার্য হিসেবে আলোচিত হচ্ছে। তিনি জাতীয় ও অন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জার্নালে ১৩০টির অধিক আর্টিকেল প্রকাশ করেন যেগুলোর সাইটেশন সংখ্যা ১১ হাজারের ওপরে।দীর্ঘ ৩২ বছরের শিক্ষকতা ও গবেষণা জীবনে ড. হারুনর রশিদ নোবলেজয়ী গবেষকদের সঙ্গেও কাজ করেন। ড. হারুনর রশীদ সৌদি আরবের কিং সৌদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৬ সাল থেকে অধ্যাপক হিসেবে লিয়েনে পাঁচ বছর কর্মরত ছিলেন। কিং সৌদ বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ এটোমিক এনার্জি কমিশন ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের মধ্যে চলমান যৌথ গবেষণা দলের নেতৃত্বও দিচ্ছেন তিনি। ২৬ মে ২০১২ তারিখে ‘দৈনিক আমার দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে তার লেখা ‘সাদা ওয়াইন ও টেকসই গণতন্ত্র’ কলামটি সেসময় ড. ইউনূসের শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যে ব্যাপক ইতিবাচক সাড়া ফেলে।
কর্মজীবনের শুরুতে তিনি খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। পরে জাপান সরকারের মনবুশো বৃত্তিতে সাগা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রি এবং টোকিও ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে প্রথম ও সাগা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় পোস্ট ডক্টরাল সম্পন্ন করেন। তিনি সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য, শিক্ষক সমিতির সেক্রেটারি, হলের প্রভোস্ট, ডিন, পদার্থবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের প্রধান ও রিসার্চ সেলের ডিরেক্টরসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন।
আলোচনায় রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. মো: হায়দার আলী বিশ্বাস। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জার্নালে তার ২৫০টির অধিক গবেষণা প্রবন্ধ ও ৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে। মেধাবী এই শিক্ষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের স্নাতকে ১ম শ্রেনীতে প্রথম ও ফ্যাকাল্টি প্রথম হয়ে প্রধানমন্ত্রী গোল্ড মেডেল লাভ করেন। পরে ফলিত গণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিতে রেকর্ড মার্ক পেয়ে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ম স্থান অর্জন করেন। তিনি ভিক্ষু শিলাচার শাস্ত্রী গোল্ড মেডেল লাভ করেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন পুরস্কার অর্জন করেছেন। তিনি ইউরোপের বিখ্যাত ইউনিভার্সিটি অব পোর্তো, পর্তুগাল থেকে পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। দেশে ও বিদেশে ১০ জন শিক্ষার্থী তার অধীনে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করছেন।
ড. বিশ্বাস বাংলাদেশ ম্যাথমেটিকাল সোসাইটির নির্বাচিত সহ-সভাপতি ছিলেন এবং তিনি বাংলাদেশ সোসাইটি ফর ম্যাথমেটিকাল বায়োলজি-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তিনি ১৮ বছরের বেশি সময় ধরে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত সিনেট সদস্য ছিলেন। গণিত ডিসিপ্লিনের প্রধান, সহকারী ছাত্র বিষয়ক পরিচালক, সহকারী হল প্রভোস্টসহ তিনি বিভিন্ন প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণায় অসামান্য অবদানের জন্য ২০২০ সালে তিনি ‘ভাইস-চ্যান্সেলর অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন।
রাশিয়ায় আয়োজিত ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অফ ম্যাথমেটিসিয়ান সম্মেলন ২০২২-এ যোগদানের জন্য একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে তিনি সেবিসেভ গ্র্যান্ড অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন। দেশে-বিদেশে প্রায় ৮০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে কী-নোট স্পিকার, অতিথি শিক্ষক এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে নিয়মিত অংশগ্রহণ করেছেন। এছাড়াও রিসার্চের জন্য ভিজিট করেছেন ২০টির অধিক দেশে। তিনি বাংলাদেশ গণিত সোসাইটি (বিএমএস), এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বাংলাদেশ (এএসবি), ইনস্টিটিউট অফ ম্যাথমেটিক্স অ্যান্ড ইটস অ্যাপ্লিকেশান ইউকে (আইএমএফ), ইউরোপিয়ান ম্যাথমেটিকাল সোসাইটি (ইএমএস) এর মতো বেশ কয়েকটি পেশাদার সোসাইটি এবং গবেষণা সংস্থার সদস্য। এছাড়াও আইইওএম সোসাইটি ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক প্রদত্ত “আউটস্ট্যান্ডিং রিসার্চার অ্যাওয়ার্ড ২০২২” পেয়েছেন এবং পেশায় ফলিত গণিত গবেষণা ও প্রকাশনার স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কার প্রাপ্ত হয়েছেন। তিনি দেশে-বিদেশে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলন, সেমিনার বা ওয়ার্কশপে স্পিকার হিসেবে ৮০টিরও বেশি বক্তৃতা দিয়েছেন। প্রফেসর বিশ্বাস ২০১৭-২০২০ এর জন্য কাউন্সিল অফ এশিয়ান সায়েন্স এডিটরস (সিএএসই) এর সদস্য এবং ২০১৭ সাল থেকে অর্গানাইজেশন ফর উইমেন ইন সায়েন্স ফর দ্য ডেভেলপিং ওয়ার্ল্ড -এর সহযোগী সদস্য হিসাবে মনোনীত হন।
ড. বিশ্বাস গণিত ফোরাম খুলনার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং ২০১৩- ২০১৫ সালে ফোরামের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত ডিসিপ্লিনের শিক্ষার্থী মীর মুগ্ধর শিক্ষক ড. বিশ্বাস আন্দোলনের শুরু থেকে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ছিলেন ও আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসায় সর্বাত্মাক সহযোগিতা করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুণ চৌধুরী। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন। ড. হারুণ চৌধুরী ৩৫টির উপরে প্রকাশনা ও একাধিক পিয়ার রিভিউ কনফারেন্স পেপার প্রকাশ করেছেন।
অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুণ ২০০৯ সালে বায়োলজিক্যাল সায়েন্স জুনিয়র ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স গোল্ড মেডেল পান। দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের পরিবেশ বিশেষত সুন্দরবন নিয়েও তিনি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন। এছাড়াও বিভিন্ন কনফারেন্স ও ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কনসালটেন্সির অভিজ্ঞতা রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী বলেন, উপাচার্য হিসেবে তারা একজন্য যোগ্য ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিকেই প্রত্যাশা করছেন। তবে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্য থেকেই প্রশাসনিকভাবে দক্ষ ও একাডেমিকভাবে বিশ্বমানের এমন কেউ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বে আসুক এমনটাই সকলের প্রত্যাশা।
শিক্ষাবিদরা মনে করছেন, আওয়ামী লীগের নমিনেশনে উপাচার্য হলেও তার একাডেমিক তথা গবেষণা ও প্রশাসনিক দক্ষতা শিক্ষার্থীদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা তৈরিতে মূখ্য ভূমিকা রেখেছে। তাই সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক ও প্রশাসনিক দক্ষতা ও যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীদের ভিসি হিসেবে নিয়োগের পক্ষে মত দেন শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।