মোস্তাক মোর্শেদ, ইবিঃ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) আবাসিক হলে র্যাগিং এর নামে ছাত্রী নির্যাতনের ঘটনার সত্যতা পেয়েছে দেশরত্ন শেখ হাসিনা হল গঠিত তদন্ত কমিটি। এর প্রেক্ষিতে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা সহ আরো ৪ অভিযুক্ত তাবাসসুম, মিম, উর্মী, মুয়াবিয়ার হলের আবাসিকতা স্থায়ীভাবে বাতিল করা হয়।
সোমবার (২৭ ফেব্রুয়ারী) বিকালে দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. শামসুল আলম তার অফিস কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে এই সিদ্ধান্তের কথা সাংবাদিকদের জানান। এসময় তিনি হল কমিটির গৃহিত লিখিত সিদ্ধান্তগুলো পাঠ করে শোনান।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, প্রভোস্ট কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে অভিযোগকারী শিক্ষার্থী ফুলপরী খাতুনের এর আবেদনে উল্লিখিত র্যাগিংয়ের নামে মানসিক ও শারীরিক অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। প্রাপ্ত সত্যতার ভিত্তিতে সানজিদা চৌধুরী অন্তরা হালিমা আক্তার উর্মি, ইসরাত জাহান মিম, তাবাসসুম ইসলাম, মুয়াবিয়া জাহান কে দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের আবাসিকতা বাতিলের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো। তাদেরকে আগামী ১ মার্চ বেলা ১২.০০ টার মধ্যে হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হলো।
এছাড়াও গৃহিত সিদ্ধান্ত গুলোর মধ্যে ছিলো অভিযুক্ত ৫ জনকে দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের হল সংযুক্তি বাতিলের সুপারিশ করা এবং অভিযুক্ত হালিমা আক্তার উর্মির বিবৃতিতে উল্লেখিত হারিয়ে যাওয়া মোবাইল ফোনটি উদ্ধারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ।
এর আগে হল তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ড. আহসানুল হক ও কমিটির সদস্য ড. নূরুল ইসলাম, ইসরাত জাহান, আসমা সাদিয়া রুনা ও মৌমিতা আক্তারের উপস্থিতিতে দুপুর সাড়ে ১২ টায় জরুরী সভা ডেকে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং গতকাল সন্ধ্যায় ৮০ পৃষ্ঠার অধিক তদন্ত প্রতিবেদনটি হল প্রভোস্ট বরাবর জমা দেয় এবং তিনি আজ প্রতিবেদনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারের কাছে জমা দেন। এছাড়াও রবিবার সন্ধ্যায় প্রতিবেদন জমা দেয় ছাত্রলীগের তদন্ত কমিটি। প্রতিবেদনে কি আছে সেটি না জানা গেলেও সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে ঘটনার আংশিক সত্যতা পাওয়া গেছে বলে জানা যায়। তবে ব্যাপারটি অস্বীকার করে তদন্ত কমিটির সদস্যরা বলেন, আমরা প্রতিবেদনটি কেন্দ্রে পাঠিয়ে দিয়েছি। পরবর্তী সিদ্ধান্ত কেন্দ্র থেকেই গ্রহণ করা হবে।
হল তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা যায়, ফুলপরীকে শারীরিক এবং মানষিক নির্যাতনের ঘটনায় হল তদন্ত কমিটি ৫ জনের সম্পৃক্ততা পেয়েছে। প্রায় ত্রিশ জনের সাক্ষাৎকার নিয়ে ৮০ পৃষ্ঠার অধিক বিস্তৃত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে। নির্যাতনের ঘটনাটি রাত ১২ টা থেকে আনুমানিক রাত সাড়ে ৩ টা পর্যন্ত ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে ১২ টা থেকে ২টা পর্যন্ত দোয়েল ১ রুমে নির্যাতন করা হয়েছে। তারপর সেখান থেকে বের করে ডাইনিং রুমে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত নির্যাতন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে বিবস্ত্র করার নির্যাতন এবং শরীরে আলপিন ফুটানোর বিষয়টিও উঠে এসেছে।
হল তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আহসানুল হক জানান, আমরা হল তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন গতকাল সন্ধ্যায় জমা দিয়েছি। আজকে দুপুর সাড়ে ১২ টা থেকে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হয়েছে। তদন্ত কমিটি সত্যতা পেয়েছে। সত্যতার আলোকে ৫ অভিযুক্তের আবাসিকতা বাতিল করা হয়েছে। এই হলের সাথে তারা কোনো সংশ্লিষ্টটা থাকবে না এই সুপারিশ করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে বিবস্ত্র করার নির্যাতন, মোবাইলে ভিডিওধারণ এবং শরীরে আলপিন ফুটানোর বিষয়টির ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই ঘটনাগুলোরও সত্যতা পাওয়া গেছে এছাড়াও যে ভিডিও করেছে সে দাবি করেছে তার মোবাইল ফোন হারিয়ে গেছে। মোবাইল ফোন উদ্ধারের জন্য প্রক্টর বরাবর চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে মোবাইল ফোন যদি লুকিয়ে রাখে তবে সেটি পাওয়া দুষ্কর।
সময় বেশি লাগার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন এত বিস্তৃত তদন্ত প্রতিবেদন লেখা এবং সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে যাচাই বাছাই করার কারণে একটু সময় লেগেছে। পুরো ঘটনার সারসংক্ষেপ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লিখিত আকারে দিয়েছি। সেই সাথে গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ ও সংযুক্ত করেছি। কোথায় কোথায় কোন কোন ঘটনাগুলো ঘটেছে, সত্যতা পেয়েছি এর আগে প্রকাশ করিনি সেক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গুলো বাস্তাবায়ন করা কঠিন হতো।
এ বিষয়ে ইবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ফয়সাল সিদ্দিকী আরাফাত বলেন, তদন্ত কমিটির কাছ থেকে আমরা যে প্রতিবেদন পেয়েছি তা গতকাল কেন্দ্রে পাঠিয়েছি। ছাত্রলীগ তার তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্টতা পায়নি এমন কথা বলা যাবে না। আমরা প্রতিবেদন কেন্দ্রে পাঠিয়েছি সিদ্ধান্ত তারাই নিবে।
ঘটনার সত্যতা পাওয়া প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান বলেন, উপাচার্য মহোদয় আসলে আমরা বসে বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা বিষয়ক যে আইন কানুন আছে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবারের কোনো সদস্যকে অসম্মান করা বা লাঞ্ছিত করা কখনই কাম্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বিধিবিধান আছে সেটা পর্যালোচনা করেই প্রতিপালন করা হবে। নিয়মশৃঙ্খলা সংক্রান্ত একটি কমিটি রয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে আমিও চাই সর্বোচ্চ শাস্তি হোক।
হল থেকে বহিষ্কারের বিষয়ে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ফুলপরী বলেন, এই সিদ্ধান্তে আমার সন্তষ্টি অসন্তষ্টির কিছু নেই তাদের যা প্রাপ্য শাস্তি তারা সেটাই পাবে। তদন্ত কমিটি যে রিপোর্ট দিয়েছে অই অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের আলোকে ব্যবস্থা নেয়া হবে এমনটাই প্রত্যাশা করি।