ডেস্ক রিপোর্ট: ২০২৪ সালের ৯ আগস্ট; মধ্য কলকাতা যেদিন ব্যস্ত প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের অন্তিমযাত্রা নিয়ে, সে দিনই আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে উদ্ধার হয়েছিল এক নারী চিকিৎসকের দেহ। অভিযোগ উঠেছিল, ওই চিকিৎসক পড়ুয়াকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে।
সেই ঘটনার ৫ মাস ৯ দিন পরে ১৮ জানুয়ারি, শনিবার সেই ধর্ষণ-খুনের মামলায় রায় ঘোষণা হতে চলেছে শিয়ালদহের অতিরিক্ত মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে। আদালত সূত্রের খবর, দুপুরে রায় ঘোষণা করতে পারেন বিচারক অনির্বাণ দাস।
আরজি কর মামলায় মোট ৫০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে নিম্ন আদালতে। সেই তালিকায় রয়েছেন নিহত চিকিৎসকের পিতা, সিবিআইয়ের তদন্তকারী অফিসার, কলকাতা পুলিশের তদন্তকারী অফিসার, ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ এবং নিহতের কয়েক জন সহপাঠী। প্রথমে ঘটনার তদন্তে নেমে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই এক সিভিক ভলান্টিয়ারকে গ্রেফতার করেছিল কলকাতা পুলিশ। ঘটনাস্থল থেকে একাধিক ‘বায়োলজিক্যাল’ এবং ‘ডিজিটাল’ তথ্যপ্রমাণও সংগ্রহ করেছিল তারা। পরে কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে তদন্তের ভার যায় সিবিআইয়ের হাতে। সিবিআইও তদন্ত চালিয়ে ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ারকেই ‘একমাত্র অভিযুক্ত’ হিসাবে বর্ণনা করে আদালতে চার্জশিট পেশ করে। সেই চার্জশিটের ভিত্তিতে মামলার চার্জ গঠন করে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল গত ১১ নভেম্বর। তার দু’মাস পর রায় ঘোষণা হতে চলেছে।
ধর্ষণ-খুনের মামলায় তথ্যপ্রমাণ লোপাটের অভিযোগে আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ এবং টালা থানার তৎকালীন ওসি অভিজিৎ মণ্ডলকেও গ্রেফতার করেছিল সিবিআই। তাদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট জমা দিতে পারেনি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। ফলে ওই মামলায় সন্দীপ এবং অভিজিৎ দু’জনেই জামিন পেয়েছেন। অভিজিতের জেলমুক্তি হলেও আরজি কর হাসপাতাল দুর্নীতির মামলায় সন্দীপ এখনও কারা হেফাজতে বন্দি।
আরজি করের ঘটনা নিয়ে গত পাঁচ মাসে একের পর এক ‘বেনজির’ ছবি দেখেছে গোটা রাজ্য এবং দেশ। নজিরবিহীন ‘নাগরিক আন্দোলন’ দেখেছে কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গ। কাতারে কাতারে মানুষ ‘ন্যায়বিচার’ চেয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে রাস্তায় নেমেছেন। রাজপথে মাইলের পর মাইল জুড়ে মানববন্ধন, মশাল মিছিল হয়েছে। ১৪ অগস্ট ‘মেয়েদের রাত দখল’ হয়েছে কলকাতাসহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে। সেই রাতেই আবার ভাঙচুর হয়েছে আরজি কর হাসপাতালে। তার পর থেকে নাগরিক সমাজের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল দাবানলের মতো। প্রায় প্রতি দিনই সাধারণ মানুষ মিছিল করেছেন কলকাতার রাজপথে। মিছিল হয়েছে মফস্বল শহরেও। গ্যালারিতে বিক্ষোভের ‘ভয়ে’ সল্টলেক স্টেডিয়ামে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের ম্যাচ বাতিল হয়েছে। ‘ডার্বি’ বাতিলের সেই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ‘নজিরবিহীন’ ভাবে একযোগে রাস্তায় নেমেছিলেন দল দু’টির সমর্থকেরা। তাদের বিক্ষোভ থামাতেও লাঠি চলেছে বাইপাসে। কলকাতার অন্যতম চওড়া রাস্তা অবরুদ্ধ থেকেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
বিস্তর ‘নাটকীয়’ ঘটনা ঘটেছে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন ঘিরেও। হাসপাতালে হাসপাতালে কর্মবিরতি দিয়ে শুরু হয়েছিল তাঁদের আন্দোলন। পরে লালবাজার অভিযান ঘিরে বৌবাজারে পুলিশি ব্যারিকেডের সামনে রাতভর অবস্থান। শেষমেশ পুলিশের ‘পিছু হটা’। কলকাতা পুলিশের তৎকালীন কমিশনার বিনীত গোয়েলকে ‘প্রতীকী শিরদাঁড়া’ দিয়ে আসা দাবিসনদ-সমেত। তারও পরে সল্টলেকের সেক্টর ফাইভে স্বাস্থ্য ভবনের সামনে টানা অবস্থান। সেখানে আচম্বিতে পৌঁছে যাওয়া মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। মুখ্যমন্ত্রীর ডাকে নবান্নে বৈঠক এবং ‘লাইভ স্ট্রিমিং’ না হওয়ায় সেই বৈঠক শুরু না হওয়া। পরে আবার মুখ্যমন্ত্রীর কালীঘাটের বাড়িতে বৈঠক। সেখানেও সরাসরি সম্প্রচার নিয়ে স্নায়ুযুদ্ধে বৈঠক ভেস্তে যাওয়া। পরে অবশ্য সম্প্রচার ছাড়াই বৈঠক হয় মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে। সেখানে খানিক ‘পিছু হটে’ সরকার। সরানো হয় পুলিশ কমিশনার বিনীতকে। অতঃপর স্বাস্থ্যভবনের সামনে অবস্থান তুলে কর্মবিরতি আংশিক প্রত্যাহার করেন জুনিয়র ডাক্তারেরা।
আরজি কর-কাণ্ডে ‘স্বতঃপ্রণোদিত’ মামলা দায়ের হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে। হাসপাতালে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে স্বতঃপ্রণোদিত পদক্ষেপ করেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়। কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে জাতীয় টাস্ক ফোর্সও গঠন করে দিয়েছিল দেশের শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ। রিপোর্টও জমা দিয়েছে সেই টাস্ক ফোর্স। সেই মামলা এখনও চলছে সুপ্রিম কোর্টে।
শাসকের বিরুদ্ধে নানা কারণে ‘পুঞ্জীভূত’ উষ্মা বেরিয়ে আসতে থাকায় স্বাভাবিক ভাবেই আন্দোলনের ‘রাশ’ নিতে চেয়েছিল প্রধান বিরোধী দল বিজেপি। ‘ছাত্রসমাজ’ নামের আড়ালে নবান্ন অভিযান হয়েছে। তাতে লাঠি চলেছে। কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হয়েছে। অভিযানকারীদের ছোড়া ইটের ঘায়ে রক্তও ঝরেছে পুলিশ-প্রশাসনের। তবে ‘রাজনৈতিক পরিপক্কতা’র পরিচয় দিয়েছে বাংলার প্রাক্তন শাসক সিপিএম। তারা আন্দোলন ‘দখল’ করতে যায়নি, বরং ঝান্ডা ছাড়া আন্দোলনকারীদের ভিড়ে মিশে থেকেছে।
জুনিয়র ডাক্তারেরা অবশ্য প্রথম থেকেই আন্দোলনকে ‘অরাজনৈতিক’ রাখতে চেয়েছেন, পেরেছেনও; অন্তত প্রকাশ্যে। কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে জুনিয়র ডাক্তারদের বৈঠকের পর কর্মবিরতি সাময়িক ভাবে উঠলেও ফের তা শুরু হয়েছিল সাগর দত্ত হাসপাতালে চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনার প্রতিবাদে। পরে ‘নানাবিধ চাপে’ সেই কর্মবিরতি তুলে ধর্মতলায় ‘আমরণ অনশনে’ বসেছিলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। পূজার মধ্যেও চলেছিল সেই কর্মসূচি। কয়েক জন অনশনকারী অসুস্থও হয়ে পড়েছিলেন।
আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন ‘রাজনৈতিক মনোভাবাপন্ন’ সিনিয়র ডাক্তারদের একাংশ। তারাই ‘দ্রোহের কার্নিভাল’ সংগঠিত করেছিলেন জুনিয়র ডাক্তারদের ‘আমরণ অনশনের’ সময়ে। ঘটনাচক্রে, সরকারি উদ্যোগে আয়োজিত দুর্গাপূজার কার্নিভাল এবং বিক্ষুব্ধ-পরিকল্পিত দ্রোহের কার্নিভাল একই দিনে এবং পাশাপাশি রাস্তায় পড়ে যাওয়ায় আন্দোলনকারীদের পরিকল্পিত নির্দিষ্ট এলাকায় ১৬৩ ধারা জারি করেছিল পুলিশ, যদিও আদালতে তা খারিজ হয়ে গিয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত ২১ অক্টোবর নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী-সহ প্রশাসনের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকের পরে আমরণ অনশন আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। যদিও কারণ হিসাবে বলা হয়েছিল, নির্যাতিতার বাবা-মায়ের অনুরোধ মেনে তাঁরা অনশন তুলছেন। নবান্নের কথায় নয়। তবে জুনিয়র ডাক্তারেরা জানিয়েছিলেন, অনশন উঠলেও আন্দোলন চলবে। তা অবশ্য ঘটেনি। অনশন ওঠার পর থেকে দৃশ্যতই ‘স্তিমিত’ হয়ে গিয়েছে তাঁদের আন্দোলন। ‘ঝাঁজ’ কমেছে নাগরিক আন্দোলনেরও। তবে শাসকের বিরুদ্ধে যে ক্রোধ তৈরি হয়েছিল, তা একেবারে চলে গিয়েছে কি না, সে বিষয়ে কেউই নিশ্চিত নন।
স্বাভাবিক ভাবেই ‘গণক্রোধ’ জিইয়ে রাখার চেষ্টায় রয়েছে বিরোধীরা। শাসকের চেষ্টা সেই ক্রোধের অপনোদন। অনেকের মতে, যত সময় গিয়েছে, শাসক সেই চেষ্টায় খানিক সফলও হয়েছে। কারণ, আরজি কর-কাণ্ডের তদন্তে নতুন কোনও ‘দিশা’ দেখাতে পারেনি সিবিআইও। কলকাতা পুলিশ যে পথে তদন্ত শুরু করেছিল, সিবিআইও সেই পথে হেঁটেই তদন্ত শেষ করেছে। এবং লালবাজারের হাতে ধৃত সেই সিভিক ভলান্টিয়ারের বিরুদ্ধেই অভিযোগ করেছে তারা। ধর্ষণ-খুনের মামলায় অন্য কারও নাম উঠে আসেনি তাদের তদন্তেও। অন্তত এখনও পর্যন্ত। মূলত যে কারণে এক সময়ে জনমানসে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রী মমতার সরকারের তদন্ত নিয়ে।
শনিবার সেই মামলারই রায় ঘোষিত হবে নিম্ন আদালতে। রায় ঘোষণা এবং সাজা ঘোষণা একই দিনে হবে কি না, তা-ও দেখার। সাধারণত প্রথম দিন অভিযুক্ত ‘দোষী’ না ‘নির্দোষ’, সেই রায়ই ঘোষিত হয়। অভিযুক্ত ‘দোষী’ প্রমাণিত হলে সাজা ঘোষণা হয়ে থাকে সাধারণত তার পরদিন। অভিযুক্ত ‘নির্দোষ’ হলে তার আর প্রয়োজন হয় না। এ ক্ষেত্রে শনিবার অভিযুক্ত সিভিক ভলান্টিয়ার ‘দোষী’ ঘোষিত হলে সে দিনই তার সাজা ঘোষণা হয় কি না, তা নিয়েও কৌতূহল রয়েছে। কারণ, তার পরদিন রবিবার আদালত সাধারণত ছুটি থাকে। তেমন হলে সোমবার শাস্তি ঘোষণা হবে।
সূত্র : আনন্দবাজার