মোহাম্মদ হাছানঃ বর্তমানে সময়ে আমাদের দেশের উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণী থেকে বৃদ্ধ সবাই যেন ভাইরাল হতে চায়। ভাইরাল হওয়ার জন্য তারা সবকিছু করতে রাজি। এমন ঘটনাও কম নয় ভাইরাল হতে গিয়ে কবরে শুয়ে থাকা বা নগ্নতায় গা ভাসিয়ে দেওয়া কিন্তু কেন তারা এত ভাইরাল হতে চাইছেন। ভাইরাল হতে চাওয়া কি সমাজে একটি মানসিক রোগে রুপান্তরিত হয়েছে?
তবে বাংলাদেশে ভাইরাল হওয়ার এক দৃষ্টান্তমূলক স্থাপন ছিল গত ৫ আগস্টে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের বিষয়, তাঁর দিকে তাকালে ঠিক উপলব্ধি করা যায় , সাবেক সরকার পতনের সাথে ভাইরাল শব্দটা একক ভাবে জড়িত । সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটা বক্তব্য ভাইরাল হয়েছিল, “সরকারি চাকরিতে বীর মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা সুবিধা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-নাতনিরা কোটা সুবিধা পাবে?” আবার এসব ইতিবাচক ঘটনার উল্টো আছে টেলিগ্রাম চ্যানেলের এক ভিন্ন জগৎ যেখানে অনেক মেয়েদের সংবেদনশীল ছবি বা ভিডিও ভাইরালের ফলে সুইসাইডের ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে। এসব বিষয় নিয়ে আজকের কিছু বিনোদনমূলক আলোচনা।
ভাইরাল বলতে আসলে আমরা যা বুঝি, কোনো ছবি, ভিডিও বা লেখা অনলাইনে ঝড়ো গতিতে বয়ে গেলে আমরা সেটাকে বলি ভাইরাল। এই ছবি, ভিডিও বা লেখাগুলো অনেক সময় ঝড়ের গতিতে যায়। তবে এর কোনো কোনোটি সমাজে মারাত্মক প্রভাব ফেলে আবার কোনটি কখনো ভালো কিছু বয়ে আনে । কিছু ভাইরাল বিষয় স্রেফ আনন্দ দিয়ে যায়, কোনোটি ভাবায় কিংবা কাঁদায়। ভাইরাল শব্দটা কিন্তু আদতে ইন্টারনেটের সন্তান। অনলাইনের ক্ষেত্রে প্রথমবারের মতো ভাইরাল শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন মার্কিন লেখক সেথ গোডিন। ২০০০ সালের ৩১ জুলাই ‘আনলিশ ইয়োর আইডিয়াভাইরাস’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন ফাস্ট কোম্পানি ডটকমে। সেখানে বলেছিলেন, ‘হ্যাভ দ্য আইডিয়া বিহাইন্ড ইয়োর অনলাইন এক্সপেরিয়েন্স গো ভাইরাল…’। প্রবন্ধটির কী হয়েছিল জানা নেই, তবে ভাইরাল শব্দটি পরে ঠিকই ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল ।
ভাইরালের কিছু সুবিধা আছে কিন্তু অসুবিধা বেশি। আগে কিছু সুবিধা দেখি বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন সৈরাচারী মনোভাব পোষণ করতে থাকলেন ঠিক তখন ৫ জুলাই চীন সফর নিয়ে গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলে, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতি কোটা পাবে না তাহলে কী রাজাকারের নাতি-পুতিরা কোটা পাবে? সেটা আমার প্রশ্ন। দেশবাসীর কাছে প্রশ্ন। মুক্তিযোদ্ধারা খেয়ে না খেয়ে কাদামাটি মাখিয়ে তারা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিল বলেই আজ দেশ স্বাধীন। আজ সবাই বড় বড় পদে আসীন। নইলে তো ওই পাকিস্তানিদের বুটের লাথি খেয়ে চলতে হতো।’ তারপর সারা দেশে বক্তব্যটা ভাইরাল হয়ে যায়। ঠিক তার পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ সব বিশ্ববিদ্যালয়ে বজ্রের গতিতে আন্দোলন শুরু হয় এবং একপর্যায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশ ত্যাগে বাধ্য হন। তাছাড়াও সেই সময়ে এই ভাইরাল হওয়া ঠেকাতে সাবেক সরকার ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, এক্স এমনকি সারাদেশ প্রায় এক সপ্তাহ ইন্টারনেট সেবা পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল কিন্তু তাতেও লাভ হয়নি। আবার বর্তমানে তরুণ তারকাদের অধিকাংশ ভাইরাল হওয়া থেকে গড়ে উঠা। তাদের অধিকাংশ টিকটকার বা ইউটিউবার। ভাইরাল হওয়ার বদৌলতে তাদের ভাগ্যের চাবিকাঠি পরিবর্তন হয়েছে। ভাইরাল হওয়া তরুণ-তরুণীদের কথা একটাই তারা বিভিন্ন কোম্পানির স্পন্সর থেকে টাকা ইনকাম করছেন বা রাতারাতি ছোট পর্দার তারকা বনে গেছেন।
তবে ভাইরাল হলে যে ভাগ্যের চাবিকাঠি পরিবর্তন হবে এমনটা কিন্তু খুব কম, এই ভাইরাল নামক মহামারীতে জীবন গেছে অজস্র তরুণ-তরুণীর । গতবছর টেলিগ্রামের গ্রুপ ‘পমপম’ সারাদেশে সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। সেই গ্রুপের সদস্যরা নানাভাবে তরুণীদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেন। কখনো কখনো এই সম্পর্ক প্রেমের পর্যায়েও রূপ নেয়। এরপর কৌশলে তাঁদের ব্যক্তিগত ছবি ও ভিডিও সংগ্রহ করেন। আবার অনেক তরুণীর ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করেন। পরে এসব ছবি ও ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে অর্থ দাবি করেন। টাকা দিতে না পারলে তরুণীদের ভিডিও কলে এনে তাঁদের ইচ্ছেমতো কাজ করাতে বাধ্য করেন। পরে সেগুলোর ভিডিও দেশে–বিদেশে বিক্রি করতেন এবং ভাইরাল করতেন। তরুণীদের সংবেদনশীল ভিডিও ভাইরাল হওয়াতে তারা আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছেন অনেকে। শুধু বাংলাদেশে প্রতিদিন পত্র পত্রিকাতে চোখ গুলোলে দেখতে পাওয়া যাবে ভাইরাল হওয়ার জন্য ট্রেনে, বাসে বা পাহাড়ে ভিডিও করতে গিয়ে মারা গেছেন অসংখ্য তরুণ তরুণী।
তবে এই ভাইরাল হওয়া যেমন নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে তেমনি কিছুটা ইতিবাচক প্রভাবও ফেলেছে। কিন্তু বর্তমান সময়ে তরুণ-তরুণীদের যেন জীবনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে ভাইরাল হতে হবে। সেটা হোক ফেসবুক, টিকটক, ইউটিউব অথবা যেকোন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আবার দেখুন এসব উস্কে দিচ্ছে দেশের একাংশ গনমাধ্যম। বাংলাদেশ বর্তমানে এমন একটা পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েছে, যেকোন বিষয়ে ভাইরাল হলে তার সঠিক বিচার পাওয়া যায় । সেটা বিচার বিভাগ অথবা কোন রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম যাই বলেন না কেন।
এই ভাইরাল মহামারি থেকে বাঁচতে হলে অবশ্যই প্রথমে দরকার ধর্মীয় বিষয়ে সঠিক জ্ঞান, পারিবারিক এবং সামাজিক সচেতনতা। ভাইরাল রোগ থেকে জাতিকে বাঁচানোর আরেকটি উপায় হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার সীমিত করা। তাহলে অন্তত আশা করা যায় একটা সময় পরে এই ভাইরাল মহামারি থেকে মুক্ত পাবে আমাদের আগামী প্রজন্ম। তা না হলে আর বছর খানেক পর দেখা যাবে করোনা মহামারির মত ভাইরাল রোগ দেশব্যাপী বিস্তার করছে যাতে শিশু-কিশোর-বৃদ্ধ সবাই আক্রান্ত।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
You might also like