আকিব জাওয়াদ ইফতিঃ ঈদ মানেই খুশি, ঈদ মানেই আনন্দ আর ঈদের উৎসব খুশিরই উৎসব। মুসলিম সমাজ ও জনজীবনে বছরে এ রকম দুটি ঈদের উপলক্ষ আসে, যার একটি ঈদুল আজহা।
বছর ঘুরে না যেতেই আবারও আগমন করছে মুসলমানদের অন্যতম আত্মশুদ্ধি ও ত্যাগের এ উৎসব। ঈদ ও আজহা দুটিই আরবি শব্দ। ঈদ এর অর্থ উৎসব বা আনন্দ। আজহার অর্থ ত্যাগ বা উৎসর্গ করা। আর এজন্যই কোরবানির ঈদকে ‘ঈদুল আজহা’ বলা হয়। অন্যদিকে ‘কোরবানি’ শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো নৈকট্য অর্জন করা, কারও কাছাকাছি যাওয়া। পারিভাষিক অর্থে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট পশু জবাই করাকে কোরবানি বলে। সব ভেদাভেদ ও মানবীয় হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে দলবেঁধে ঈদের নামাজ আদায় করে পারস্পরিক আলিঙ্গনের পর পশু কোরবানির মাধ্যমে এক মহাউৎসব পালিত হয়, যা সমাজে ভাতৃত্বপূর্ণ সহবস্থান সৃষ্টি করে।
পবিত্র ঈদুল আজহার এ উৎসব আদি পিতা হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু হয়ে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। মহান আল্লাহ এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানির বিধান নির্ধারণ করে দিয়েছি, যাতে তারা ওই পশুদের জবাই করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। আর তোমাদের প্রতিপালক তো এক আল্লাহই, তোমরা তারই অনুগত হও।’ (সুরা হজ : ৩৪)। মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) ও তার পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.) এর ঐতিহাসিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কোরবানি ইবাদতের মর্যাদা লাভ করেছে। দীর্ঘ প্রার্থনা ও প্রচেষ্টার পর ৯০ বছর বয়সে ইবরাহিম (আ.) সন্তানের পিতা হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন। কিন্তু যখন আল্লাহ ইবরাহিম (আ.)-কে পরীক্ষা করার জন্য স্বীয় পুত্রকে কোরবানি করতে বললেন, তখন কোনো সংশয় তথা বিনা প্রশ্নে নিজ স্নেহাস্পদ সন্তানকে কোরবানি করতে নিয়ে গেলেন। ইবরাহিম (আ.) এর প্রিয় বস্তু কোরবানির এমন ত্যাগ ও একনিষ্ঠতায় খুশি হয়ে আল্লাহ সমগ্র মুসলিম জাতিকে আত্মত্যাগ ও তার হুকুম পালনে একনিষ্ঠতা শিক্ষা দেওয়ার জন্য কোরবানির এ বিধান ইবাদতের মর্যাদায় নাজিল করেন। যে বিধান যথাযথভাবে পালন করেছেন আল্লাহর প্রিয় রাসুল মুহাম্মদ (সা.) ও তার সাহাবিরা। সেই ধারাবাহিকতায় বর্তমান মুসলিম জাতিও আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সামাজিক সম্প্রীতি অর্জনের লক্ষ্যে কোরবানি করে যাচ্ছে।
ইসলামে কোরবানির মাধ্যমে মুসলমানদের সাম্য, সম্প্রতি ও ভাতৃত্ববোধ জাগ্রত করে সামাজের আদর্শ মানুষ হতে শিখায়। সমাজের শ্রেণিগত বিভেদ দূর করে দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর শিক্ষা দেয় । পশু কোরবানির মাধ্যমে মানব মনে বিরাজমান যাবতীয় পশুত্ব তথা নির্মমতা, ক্রোধ, হিংসা, অত্যাচারী মনোভাবের অশুভ কর্মকাণ্ডের মূলোৎপাটন ঘটানোর দীক্ষাই কোরবানির মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহ পেয়ে থাকে। নিকটাত্মীয় ও প্রতিবেশীদের মধ্যে কোরবানির মাংস বণ্টনের মাধ্যমে সামাজিক সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের আবহ তৈরি হয়। মানবতাবোধের জয়ধ্বনি দিয়ে মুসলিম সমাজের সব শ্রেণির মানুষ সব ধরনের মতপার্থক্য ভুলে একে অন্যের সঙ্গে ঈদের আনন্দ বিনিময় করে জবাইকৃত পশুর মাংস নিকটাত্মীয় ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেয়, যাতে রয়েছে সামাজিক সমতার মহান আদর্শ।
কোরবানির মাংস কাউকে দান করা অন্যান্য দান-সদকার চেয়ে উত্তম। রাসুল (সা.) বলেছেন, মানুষের কল্যাণ-সংশ্লিষ্ট যত কাজ আছে, তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম হচ্ছে দরিদ্র ও ক্ষুধার্তকে খাবার দান করা (বোখারি : ১২)। কোরবানির বিধানের মাধ্যমে সমাজে একের সম্পদে অন্যের অধিকারের বিষয়টি বিশেষভাবে উন্মোচিত হয়ে। ইসলাম শুধু ব্যক্তিকেন্দ্রিক সম্পদ অর্জন ও ভক্ষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সমাজের সার্বিক কল্যাণময় কার্যক্রমে এগিয়ে আসতে বিশেষভাবে উৎসাহিত করে। কোরবানি শুধু ধর্মীয় উৎসবই নয়; বরং ত্যাগের দীক্ষায় পরিশুদ্ধ জীবন গঠন ও ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ গঠনের নিয়মতান্ত্রিক অনুশীলনও বটে।
ঈদুল আজহা সমাজের মানুষের হৃদয়ে আত্মত্যাগের শিক্ষাকে প্রোথিত করে মানবিক মূল্যবোধ জাগিয়ে বিশেষ অনুপ্রেরণাই দিয়ে থাকে। যার ফলশ্রুতিতে প্রতিবছর ঈদ মুসলমানদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করে পারস্পরিক ভালোবাসা ও সম্প্রতির সংযোগ-মোহনায় দাঁড় করিয়ে সামাজিক মানবতাবোধের শক্তিতে বলীয়ান করে। কোরবানি মুসলমানদের সব কর্মের উদ্দেশ্য ও নিয়ত সম্পর্কে সুস্পষ্টতা দেয়। অর্থাৎ মানবজীবনের সব কাজ হতে হবে- শুধু মহান রবের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। তাতে থাকবে না কোনো লৌকিকতা বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থ। কেননা, কর্মের উদ্দেশ্য সঠিক বা পরকল্যাণমুখী না হলে বিশৃঙ্খলার সম্ভাবনা থাকে। তাই আল্লাহ যেকোনো কাজের আগে নিয়ত ও উদ্দেশ্য ঠিক করতে বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেছেন।
পবিত্র ঈদুল আজহার সঙ্গে আর্থসামাজিক উন্নয়নেরও বিশেষ সম্পর্কও পরিলক্ষিত হয়। কোরবানি ঈদকে কেন্দ্র করে দেশের নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ ও খামার ব্যাবসায়ীরা বিশেষ পুঁজি বিনিয়োগ করে থাকেন। শুধু ঈদণ্ডপূর্ববর্তী এক সাপ্তাহে পশু ও কোরবানির সরঞ্জামাদি ক্রয়-বিক্রয় ও পশুপরিবহন ইত্যাদি খাতে দেশে কয়েক হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়। বিত্তবান মুসলমানদের থেকে দান-সদকার মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের অর্থ নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে হাতবদল হয়। যার ফলে দেশের অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চারিত হয়।
মানব সভ্যতার শুরু থেকে এখনো পর্যন্ত মুসলমানদের জন্য কোরবানির ত্যাগ ও সম্প্রীতির শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা, ত্যাগ-ব্যতীত কেনো সমাজ ও সভ্যতা বিনির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। পিতামাতার ত্যাগ ও কোরবানির বদৌলতেই সন্তান প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠে। তেমনি কোরবানি মুসলমানদের শুধু আনন্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সব ধরনের হিংসাবিদ্বেষ ও ভেদাভেদের কালো পাথরকে ভেঙে দিয়ে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সহানুভূতিশীল আচরণের শিক্ষাই দেয়, যা তাদের ঐক্যের বন্ধনে একীভূত করে শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে অনুপ্রাণিত করে। ঈদুল আজহার আত্মত্যাগের শিক্ষা ও আদর্শ গ্রহণ করে বাস্তব জীবনে সেটি প্রতিফলিত করতে পারলেই শান্তিপূর্ণ সামাজিক সহবস্থান নিশ্চিত হবে ইনশাআল্লাহ।
লেখক: শিক্ষার্থী, আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।