এইচ. এম. মশিউর রহমান: সারা দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে যে চিত্র দেখতে পাই সে দৃশ্য আমাদের সবার মনেই এক ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাবে প্রভাবিত করে। সমগ্র দেশজুড়ে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যেন অবনতির তলানীর দিকে ধাবিত হচ্ছে। মানুষ আতঙ্কে মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাত্রা আর স্বাভাবিক নেই।। মানুষের জীবন আতঙ্কে ক্রমাগত দূর্বিষহ হয়ে উঠছে।
সম্প্রতি ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায় একটি দোকানে অস্ত্রধারীরা ঢুকে ডাকাতি ও এক তরুণীকে চাপাতি হাতে দৌড়ানোর ঘটনাসহ একের পর এক অপরাধমূলক ঘটনার পর এলাকাবাসীর বিক্ষোভের পর সেনাবাহিনীসহ যৌথ বাহিনীর অভিযানে ৪৫ জনকে আটক করা হয়েছে।
ঢাকাসহ কয়েকটি এলাকার অস্ত্রধারীদের দৌরাত্ম এবং প্রকাশ্যে চাপাতি রামদা নিয়ে আক্রমণ কিংবা দৌড়াদৌড়ির মতো বেশ কিছু ঘটনার ভিডিও ফুটেজ সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গেছে।
বিশেষ করে ধারালো অস্ত্র নিয়ে একদল তরুণ এক তরুণীকে ঘিরে ধরে টানা হেঁচড়া করছে, ওড়না টেনে রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে আর তরুণী দৌড়ে বাঁচার চেষ্টা করছেন বা মিনি সুপারশপে চাপাতি হাতে কয়েকজন ঢুকে সবাইকে বেরিয়ে যেতে বলছে- এমন দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠেছে মানুষ।
সাম্প্রতিক এই দুটি ঘটনাই মোহাম্মদপুর এলাকার। ওই এলাকার বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী ইব্রাহীম খলিল বলছেন, পাঁচই অগাস্টের পর কয়েকদিন ছিলো ডাকাতির আতঙ্ক আর এখন কিছুদিন ধরে দেখা যাচ্ছে দলবদ্ধ ভাবে কিশোর তরুণরা ঘুরাঘুরি করছে, একে ওকে হামলা করছে এবং ভয়ে তাদের কেউ কিছু বলতে পারছে না।
ফয়েজুর মোল্যার বাড়ি নড়াইল সদর উপজেলার তুলারামপুর এলাকায়। তেলের পাম্পে গাড়ি চালিয়ে সংসার চালান ফয়েজুর পাশাপাশি গরু পালন করেন তিনি। সকালে দেখে খামারে একটা গরুও নাই। তিনি বলেন ঋণের টাকায় গরু কিনে পাইলে-পুইষে বড় বানালাম। চোরেরা গরুগুলো নিয়ে আমারে পথে বসায় দিয়ে গেল। পাম্পের গাড়ি চালাইয়ে যা আয় করতাম, তা দিয়ে খাইয়ে-পইরে বাকি সব খরচ করতাম ওই গরুর পিছনে। চার বছর ধরে কষ্ট করে বানানো খামারডা ধ্বংস করে দেল। আমারে একেবারর পঙ্গু কইরে দিয়ে গেল।’
নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার একটি ইউনিয়নের চর এলাকায় মা ও মেয়েকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। নীলফামারীর সৈয়দপুরে ক্ষুদ্রঋণের ২৫ হাজার টাকা নিয়ে ব্যাংক থেকে বের হতেই ছিনতাইয়ের শিকার হওয়ার পরেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন এক ব্যক্তি।
ফরিদপুর শহরের ব্রাক্ষ্মণকান্দা এলাকায় ছিনতাইয়ের অভিযোগে কনস্টেবলসহ দুজনকে পিটুনি দিয়েছেন স্থানীয় লোকজন।ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা ছিনতাই করতে রিফাত মিয়া নামের অটোরিকশাচালককে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা।
এছাড়া গত পাঁচই অগাস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পুলিশি ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে গেছে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ডাকাতি ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে চলছে। সারাদেশে খুন, ধর্ষণ, ডাকাতির মতো মারাত্মক অপরাধ জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব অপরাধের বিবরণ ও ধরন এমন যে কোনো সুস্থ্য এবং বিবেকবান মানুষের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়। গা শিউরে উঠা একেকটি ঘটনা মানুষের মনোজগতে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। একশ্রেণীর মানুষের বর্বরতা ও নৃশংসতা মধ্যযুগকেও হার মানাচ্ছে। কোনোভাবেই যেন এই নিষ্ঠুরতা বন্ধ করা যাচ্ছে না। এসব ঘটনার গ্রাফ ক্রমেই উর্ধ্বমুখী। আইন তার যথার্থ কার্যকারিতা হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। সর্বময় ভয়ের রাজত্ব। মানুষ কোথাও শান্তিতে তাদের স্বাভাবিক কাজ সম্পাদন করতে পারছে না। সবার মনে এক অদৃশ্য আতঙ্ক।
আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা যদি দ্রুত মানুষের মনের এই আতঙ্ক দূর করতে সক্ষম না হয়ে উঠতে পারে তাহলে মানুষ ধীরে ধীরে তাদের স্বাভাবিক জীবন ব্যবস্থা থেকে দূরে ছিটকে পড়বে। যার ফলস্বরূপ রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, সামাজিক, ও অন্যান্য সকল সেক্টরে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সেই কারণে এই মুহুর্তে সকলে মিলে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে এলাকাভিত্তিক সচেতনতামূলক কার্যক্রম হাতে নেয়া দরকার। সমাজের বিশিষ্টজনদের সাথে নিয়মিত বৈঠক ও আলাপ-আলোচনা করে দিক নির্দেশনা দেয়া উচিত। সংশ্লিষ্ট থানা এলাকায় কারা কোন অপরাধের সাথে জড়িত তার তালিকা নিশ্চয়ই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে রয়েছে। এ তালিকা ধরে অপরাধীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা অপরিহার্য। অপরাধী যেই হোক, তাকে অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করে আইনানুগ পদক্ষেপ নিতে হবে। সামাজিক মূল্যবোধ অটুট রাখতে এবং অবক্ষয় ঠেকাতে এলাকার অভিভাবকদের সক্রিয়া হওয়া বাঞ্চনীয়। পরিবারের প্রতিটি সদস্যর আচার-আচরণের দিকে অভিভাবকদের যথাযথ দৃষ্টি রাখতে হবে। তবেই আমরা এই মুহূর্তের এই অরাজক পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে পারবো বলে আশা রাখি।
লেখক: আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী।