অল্প টাকা বিনিয়োগ করে যদি হাজার টাকা কামানো যায় তাহলে তো এই সংকটকালে সবার আগ্রহ থাকবেই । কারো আগ্রহ না হলেও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে আগ্রহ একটু বেশি । কারণ হিসাবে বলা যায় দেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গ্রাম্য অঞ্চলে গড়ে তোলা হয়। সেখানে শিক্ষার্থীদের আয় করার মাধ্যম সংকীর্ণ । তাছাড়া সরকার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের এমন কোন ভাতা বা আয়ের সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে না যে তারা নির্ধিদায় পড়ালেখা চালিয়ে যাবে। তাই কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থীরা সহজ আয়ের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে অনলাইনে জুয়ার প্লাটফর্মকে।
অবৈধ উপায়ে আয়ের মাধ্যম বলতে অনলাইন জুয়া বা সরাসরি জুয়া খেলে অবৈধ উপর্জনকে বুঝানো হয়েছে। অনলাইন জুয়া হলো এমন ধরনের খেলা যা লাভ বা লোকশানের মধ্যে ঝুলন্ত থাকে। এ খেলায় মূলত নির্দিষ্ট পরিমানের অর্থ নির্ধারণ করা হয়। তারপর কোনো একটি বিষয়ে দুই পক্ষ চুক্তি করে হার জিত নির্ধারণ করে। যে পক্ষ হেরে যায় সে অপর পক্ষকে সেই নির্ধারিত অর্থ প্রদান করে।
শিক্ষার্থীরা এ অনলাইন জুয়ার মাধ্যম থেকে সাময়িকভাবে স্বচ্ছল হলেও তাদের লোভ এবং আসক্তি গ্রাস করে নিচ্ছে জ্ঞান চর্চার ও বিতরণের অধিকাংশ সময়। শিক্ষার্থীদের কাছে সামাজিক সমস্যার মতো রূপ ধারণ করেছে এ অনলাইন জুয়া। বিশেষ করে সেই সকল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা যাদের আয়ের উৎস নেই বললেই চলে । তাদের কাছে জনপ্রিয় কিছু অনলাইন জুয়ার সাইট 1x bet, অনলাইন ক্যাসিনো, অনলাইন লুডু সহ আরো অনেক ধরনের খেলা।
এ ধরনের জুয়ার সাইটে সাধারণ মোবাইল নম্বর বা ইমেইলের মাধ্যমে একাউন্ট খুলতে হয় এবং তার বিপরীতে ই-ওয়ালেট খুলে ব্যালেন্স যোগ করে ওই টাকায় জুয়া খেলা হয় । জুয়া বাবদ মোবাইল ওয়ালেট ছাড়াও ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমেও লেনদেন হয়, আবার এজেন্টের মাধ্যমে নগদে জুয়ার টাকা লেনদেন করা হয় ।
এসব অনলাইন জুয়ার এতো বিস্তারের অন্যতম কারণ তারা বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেলে বিজ্ঞাপন প্রচার করে থাকে। ২৪ ফেব্রুয়ারি আমরা এমন একটা ঘটনা দেখি নারায়ণগঞ্জে। সেখানে কয়েকজন জনপ্রিয় ইউটিউবারকে গ্রেপ্তার করা হয় কারণ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তাদের সাথে ভারতীয় এক জুয়ার এজেন্টের গত তিন বছর ধরে জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচারের চুক্তি রয়েছে। সেই চুক্তি অনুযায়ী, অভিযুক্তরা তাদের নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলের এক ওয়েব সিরিজে নিয়মিত বিজ্ঞাপন প্রচার করে আসছে। জুয়ার ব্যবসা প্রচারে বিজ্ঞাপনগুলো এখনও চলছে। প্রতি পর্বে একেকটি বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য ওই ভারতীয় এজেন্টের থেকে অভিযুক্তরা ৭০ হাজার থেকে এক লাখ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকতো বলে সংবাদ মাধ্যমগুলো থেকে জানা যায় ।
তারা শুধু ইউটিউব চ্যানেল থেকেই না গতবছর আরেকটা ঘটনা দেখা গিয়েছিল দেশের সংবাদমাধ্যমে , গত ১১ই ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খন্দকার হাসান শাহরিয়ার এবং ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী ইসমাতুল্লাহ লাকী তালুকদার অনলাইন জুয়ার সাইটের বিজ্ঞাপন প্রদর্শন বন্ধে ওই বেসরকারি টিভি চ্যানেলটিকে লিগ্যাল নোটিশ দেন। ওই নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছেছিল অনলাইন জুয়ার সাইটের বিজ্ঞাপন ও লোগো প্রচার, প্রকাশ, সম্প্রচার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করার পাশাপাশি অদূর ভবিষ্যতেও সব প্রকার জুয়ার সাইটের বিজ্ঞাপন প্রচার, প্রকাশ তথা সম্প্রচার থেকে বিরত থাকার জন্য তিন দিনের সময় দিয়ে লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়।
ওয়ার্ল্ড গ্যাম্বলিং মার্কেট এর তথ্য অনুসারে ২০২২ সালে শুধুমাত্র অনলাইন জুয়ার বাজারমূল্য ছিল ৬৩৫৩ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২৩ সালে এর ব্যাপ্তি ১১.৭% বাড়বে বলে ধারণা করা হয়েছিল তবে অনলাইন জুয়ায় এ বাজারমূল্যের গ্রাফ ক্রমশ উর্ধ্বমুখী।
তবে বাংলাদেশে জুয়া প্রতিরোধে প্রচলিত কিছু আইন আছে তবে সে আইন কতটুকু কার্যকর তা আমরা বলতে পারছি না । ১৮৬৭ সালে অর্থাৎ ব্রিটিশ আমলে প্রণীত জুয়া প্রতিরোধ আইন এবং এতে সাজার পরিমাণও খুব নগণ্য। পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট ১৮৬৭, সেকশন ৩ অনুযায়ী, যে কোনও ঘর, স্থান বা তাঁবু জুয়ার আসর হিসেবে ব্যবহৃত হলে তার মালিক বা রক্ষণাবেক্ষণকারী, জুয়ার ব্যবস্থাপক বা এতে কোনও সাহায্যকারী তিন মাসের কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ২০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট, ১৮৬৭ সেকশন ৪ অনুযায়ী, কোনও ঘরে তাস, পাশা, কাউন্টার বা যেকোনো সরঞ্জামসহ কোনও ব্যক্তিকে জুয়া খেলারত বা উপস্থিত দেখতে পাওয়া গেলে তিনি এক মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ১০০ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
অনলাইন জুয়ার মাধ্যমগুলো কিছু শিক্ষার্থীদের কাছে এখন মৌলিক চাহিদার মতো হয়ে পড়েছে চাইলেই বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। এসব অনলাইন জুয়ার মাধ্যমগুলো বন্ধ করতে হলে সরকারকে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করতে হবে পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের খন্ডকালীন কাজ বা ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে হয়তো সমাধান মিলবে নাহলে এই বিশ্বায়নের যুগে নামমাত্র অনলাইন জুয়ার সাইট বন্ধ বা ব্রিটিশ আইন প্রয়োগ করা অর্থহীন ।
মোহাম্মদ হাছান, শিক্ষার্থী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ।