The Rising Campus
Education, Scholarship, Job, Campus and Youth
শুক্রবার, ১৩ই ডিসেম্বর, ২০২৪

সমস্যা নয় সমাধানের রাজনীতি প্রয়োজন

নাইমুর রহমান: অনেক বছর ধরেই আমরা ‘বিজয়ী সব সুযোগ-সুবিধা কুক্ষিগত করবে’– এ সংস্কৃতি থেকে রাজনীতিকে বের করে আনার পথ খুঁজছি। প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে এ ব্যাপারে একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হতে হবে যে, রাজনীতির খেলায় হেরে যাওয়া মানেই জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়া নয়।

প্রতিটি দেশের উন্নয়ন, সমৃদ্ধিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীল পরিস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। রাজনীতি বলতে বোঝায় এমন একটি প্রক্রিয়া বা ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে কোনো সমাজ বা রাষ্ট্রের মধ্যে ক্ষমতা অর্জন, পরিচালনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এটি ক্ষমতার ব্যবহার, বিতরণ এবং সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করে এবং সমাজের কল্যাণ, ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সুশাসন নিশ্চিত করতে সহায়তা করে। বিভিন্ন মনীষীর দৃষ্টিকোণ থেকে রাজনীতির সংজ্ঞা দিয়েছেন যেমন –

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক অ্যারিস্টটল তাঁর বিখ্যাত “ পলিটিক্স “ বইয়ে রাজনীতিকে “মানুষের সামাজিক জীবনের একটি স্বাভাবিক অংশ” হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন যে “মানুষ স্বভাবতই একটি রাজনৈতিক প্রাণী।”

আবার ,ম্যাকিয়াভেলি তার বিখ্যাত গ্রন্থ “দ্য প্রিন্স” এ ম্যাকিয়াভেলি রাজনীতিকে ক্ষমতা দখল ও তা বজায় রাখার কৌশল হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে রাজনীতির মূল লক্ষ্য হলো রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা রক্ষা করা।
এই সংজ্ঞা দুটি থেকে বোঝা যায় যে রাজনীতি কেবল রাষ্ট্র পরিচালনার সাথে নয়, বরং সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ ও শক্তির ভারসাম্য রক্ষা করার সাথে সম্পর্কিত।

এখন আসি রাজনীতি কেন প্রয়োজন সেটির আলোচনায় , রাজনীতি একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি সমাজের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও শাসনের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা নিচে দেওয়া হলো:

 শৃঙ্খলা ও সুশাসন নিশ্চিত করা

রাজনীতির মাধ্যমে সমাজে শৃঙ্খলা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। একটি কার্যকর রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করে যে আইন এবং বিধিবিধানগুলো প্রয়োগ হচ্ছে, যা সমাজের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সহায়তা করে। এটি সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও অপরাধ কমাতে সাহায্য করে।

সিঙ্গাপুর সরকার কঠোর আইন ও বিধিনিষেধের মাধ্যমে শৃঙ্খলা এবং সুশাসন নিশ্চিত করেছে। সেখানে পাবলিক প্লেসে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা এবং শৃঙ্খলার জন্য বিভিন্ন আইন আছে, যা দেশের উন্নয়ন ও সুশাসনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।

 ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখা

রাজনীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষমতার স্তরগুলো যেমন নির্বাহী, আইনসভা এবং বিচার বিভাগ পরস্পরের ভারসাম্য রক্ষা করে। ক্ষমতার এই ভারসাম্য নাগরিকদের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষা করতে সাহায্য করে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামোতে “চেকস অ্যান্ড ব্যালান্সেস” পদ্ধতি আছে, যা নির্বাহী, আইনসভা এবং বিচার বিভাগের ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখে। প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা যেমন কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণে থাকে, তেমনি সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে আইনের সংবিধানসম্মততা বিচার করা হয়।

 সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন

রাজনৈতিক নেতৃত্ব একটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষার প্রসার, স্বাস্থ্যসেবা ও বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। এর ফলে দেশের সামগ্রিক উন্নতি ঘটে।

 জনগণের অধিকার ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা

রাজনীতি জনগণকে তাদের মতামত প্রকাশের সুযোগ দেয় এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণ তাদের চাহিদা ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে পারে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণ ভোটের মাধ্যমে নেতৃবৃন্দ নির্বাচন করতে পারে, যা জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করে।

 নীতিমালা ও আইন প্রণয়ন

রাজনৈতিক নেতারা ও আইনপ্রণেতারা বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা তৈরি করেন যা সমাজের কল্যাণ এবং সুষ্ঠু জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয়। এই নীতিমালা দেশের প্রশাসনিক কাঠামোকে সংগঠিত ও কার্যকর করে তোলে।

সুইডেনে পরিবেশ সুরক্ষায় বিভিন্ন কঠোর আইন প্রণীত হয়েছে, যেমন পরিবেশ সংরক্ষণ আইন যা বায়ু ও পানির দূষণ কমাতে সাহায্য করেছে। এটি একটি উদাহরণ যে কীভাবে সঠিক নীতিমালা একটি দেশের পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যকে রক্ষা করতে পারে।

 সংঘাত ও মতবিরোধ সমাধান

রাজনীতির মাধ্যমে বিভিন্ন সমাজের গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ ও মতবিরোধ সমাধান করা সম্ভব। আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতারা সমস্যার সমাধানে পৌঁছাতে পারেন, যা সংঘাতের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়।

 বিশ্বব্যাপী সম্পর্ক উন্নয়ন

রাজনীতি শুধু অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সীমাবদ্ধ নয়, এটি বৈদেশিক সম্পর্ক গড়ে তুলতেও সহায়তা করে। কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিভিন্ন দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে যা বাণিজ্য, পর্যটন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) গঠনের মাধ্যমে ইউরোপের দেশগুলো অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সহযোগিতায় এগিয়ে গেছে। ইইউ এর মাধ্যমে সদস্য দেশগুলো একে অপরের সাথে কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক, ও সামাজিক সম্পর্ক উন্নত করেছে, যা বিশ্বব্যাপী শান্তি ও স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করেছে।

 সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সংরক্ষণ

রাজনৈতিক নেতারা তাদের সমাজের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ রক্ষায় ভূমিকা পালন করেন। তারা নীতিমালা তৈরি করেন যা একটি দেশের ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং সংস্কৃতির উন্নয়নে সহায়ক হয়।

আমরা এখন জানার চেষ্টা করব রাজনৈতিক দল কাকে বলে?

এই বিষয়ে প্রখ্যাত অস্ট্রিয়ান অর্থনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক বিজ্ঞানী জোসেফ শুম্পিটার তাঁর “Capitalism, Socialism and Democracy” বইয়ে বলেছেন, “রাজনৈতিক দল হলো এমন একটি দল যা নির্বাচনে জনগণের ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা লাভ করার চেষ্টা করে এবং তাদের আদর্শ ও নীতি অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালনা করে।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহাবস্থানের উপর দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বও নির্ভরশীল। স্বাধীনতা অর্জনের পর প্রাকৃতিক, খনিজ এবং পর্যটনে সমৃদ্ধ হওয়ার পরও অনেক দেশ শুধুমাত্র রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে প্রত্যাশিত সমৃদ্ধির মুখ দেখে নি। আমাদের দেশে বর্তমানে এক দলকে অপর দলের ঠুনকো বিষয়গুলো নিয়ে কাঁদা ছুঁড়াছুড়ি করতে দেখা যায়, জাতীয় সংসদে পর্যন্ত অন্য দলের নেতৃবৃন্দের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেও দেখা গেছে অনেক সাংসদকে। কয়েক দিন পর পর ছোট কাট ইস্যু তৈরি এবং সেই ইস্যুতে মাঠ গরম যেন এক ধরনের সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ, কোনও সভ্য দেশে এসব কখনো কাম্য নয়। ভিনদেশীরা এই দুর্বলতাগুলোকে কাজে লাগিয়ে দেশের অনেক স্বার্থ নষ্ট করে ওরা নিজদের ফায়দা লুঠে নেয়। ‍উদাহরন হিসেবে ভারতের কথা বলা যেতে পারে . ভারত তার উজানে অবস্থিত নদীগুলোতে অবৈধভাবে বাঁধ ও ব্যারেজ নির্মাণ করে নদীর পানি আটকে রাখছে এবং নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে ভারতের ভেতরেই প্রবাহিত করছে। ফলশ্রুতিতে ওই নদীগুলোর বাংলাদেশের ভাটি অংশগুলো পানির অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে এবং নাব্য ও গভীরতা হারাচ্ছে। এদিকে ভারতীয় অংশের উজানের নদীগুলোতে যখন পানি অভারলোডেড হয়ে যায়, তখন ভারত সরকার সেই নদীগুলোর ওপর বাঁধ ও ব্যারেজগুলোর গেট খুলে দেয়, যার কারণে বাংলাদেশের অংশের শুষ্ক নদীগুলোতে ব্যাপক পানি প্রবেশ করে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ভারতের আগ্রাসন দেখেছি, রাষ্ট্রীয় কাজে ভারতের হস্তক্ষেপ দেখেছি নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে দেখেছি। সর্বপুরী বাংলাদেশকে একটি প্রদেশে পরিণত করারও নিরন্তন প্রচেষ্টা দেখেছি । একসময় দেশের স্বাধীনতা–সার্বভৌমত্ব রক্ষাও কাল হয়ে যায়। তাইতো, ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তস্নাত লাল–সবুজের পতাকা শোভিত বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চি মাটির স্বাধীনতা–সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সকল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহাবস্থান বর্তমানে একান্ত জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিভিন্ন সময়ে নানা উত্থান-পতন ও ঘটনাপূর্ণ ঘটনার মধ্য দিয়ে গেছে। দেশের রাজনীতি মূলত দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল—বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)—কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। এছাড়া, জামায়াতে ইসলামীসহ আরও কিছু ছোট দল রাজনীতিতে ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের রাজনীতি সাধারণত আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, নির্বাচনকালীন সহিংসতা এবং সামরিক শাসনের প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠেছে।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয় এবং ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নতুন সংবিধান গৃহীত হয়। এরপর বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালে একটি সামরিক শাসনের যুগ শুরু হয়।

১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড এবং পরে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সামরিক শাসন ১৯৮২ সালে শুরু হয়। এরশাদের শাসনকাল এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলে এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যায়।

১৯৯০ সালে ছাত্র ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে এরশাদবিরোধী গণআন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে। ব্যাপক জনমতের চাপে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ সালে পদত্যাগ করেন। এটি সামরিক শাসনের অবসান ঘটায় এবং বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন হয়।

১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসে এবং সংসদীয় শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করা হয়। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে পালাক্রমে সরকার পরিবর্তন হতে থাকে, যা রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং দ্বন্দ্বের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা, হরতাল, বিক্ষোভ এবং সহিংসতা দেখা গেছে। ক্ষমতার পরিবর্তনে সামরিক হস্তক্ষেপের আশঙ্কাও বারবার দেখা গেছে, যদিও ১৯৯০ সালের পর আর কোন সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতিতে স্বাধীনতার পক্ষ এবং বিপক্ষ শক্তির প্রশ্ন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্ক ও সমালোচনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আরো একটু পিছনে ফিরতে চাই,

১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি, স্বাধীন দেশে রঞ্জিত হলো ঢাকার রাজপথ। ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও মার্কিন আগ্রাসনের প্রতিবাদে মিছিল করতে গিয়ে শহীদ হলেন ছাত্র ইউনিয়নের মতিউল-কাদের। ১৯৭৪ সালের ৪ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলে সংঘটিত হলো ছাত্রলীগের ন্যক্কারজনক সাত খুনের ঘটনা। ১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ক্রসফায়ারের শিকার হলেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সিরাজ সিকদার। সংবিধান কাঁটাছেড়া ও নিত্যনতুন বিধিব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বাকশাল প্রবর্তনের ফলস্বরূপ ইতিহাসের ক্রিটিক্যাল বিশ্লেষকদের মত হলো, তাঁর হাতেই সূত্রপাত ঘটেছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম স্বৈরাচারী রাজনৈতিক বন্দোবস্তের। আহমদ ছফার বিখ্যাত গ্রন্থ যদ্যপি আমার গুরু-তে এই বয়ানের যথার্থতা মেলে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে আলাপচারিতায় (পৃষ্ঠা ৭৩):

সাঈদ শহীদ হন ১৬ জুলাই। ডানা মেলা পাখির মতো দুই হাত প্রশস্ত করে বুক পেতে ঘাতকের সামনে দাঁড়ানোর তাঁর দুঃসাহসিক মৃত্যুদৃশ্য লাইভ কিংবা ধারণকৃত ভিডিওর মাধ্যমে দেখা গেছে। ইন্টারনেটের যুগে মুহূর্তেই ছড়িয়ে গেছে এ দৃশ্য দুনিয়াব্যাপী। কিন্তু তখনো সাঈদ বা সাঈদদের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ছিল না, তখনো তা কোটা সংস্কার বা বড়জোর বৈষম্যবিরোধিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। অথচ তাঁর মৃত্যুই পুরো আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল, আন্দোলনকে করে তুলেছিল আরও আগুয়ান, বেগবান ও জনসম্পৃক্ত। সেখান থেকে মাত্র ২০ দিনের মাথায় দুনিয়ার দীর্ঘতম জুলাইয়ের পরিসমাপ্তি এবং স্বৈরতন্ত্রের পতন।

স্বৈরশাসন, ক্ষমতার শক্তি প্রদর্শন, বিরোধী পক্ষের ওপর জুলুম, ব্যাবিচার, মামলা, নির্যাতন, হামলা, গুম ও খুন এ সব জঘন্য চরিত্র গণতন্ত্রের জন্য বিপরীত, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গণতন্ত্রের চর্চা এবং বাধাপ্রাপ্তি যথেষ্টভাবে সমালোচনা হচ্ছে। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গণতন্ত্রের চর্চা ও অনুশীলন রাজনীতির মাঠ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। গণতন্ত্রের চর্চার রাজনীতি ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। ফলে জঙ্গিবাদ সন্ত্রাসবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদী চরিত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটছে। প্রকাশ্যে রাজনীতির কার্যক্রম অবাধভাবে চালু না থাকলে জঙ্গি তৎপরতা, সন্ত্রাসী কর্মকান্ড উৎপাদন পরিচালনা বাড়াতে থাকে। রাজনীতির মাঠ-ময়দান, ভাষণ, জনসভা সীমিত হলে সন্ত্রাসের পথ বেচে নেয় আন্দোলনের জন্য। দমননিপীড়ন কোনোভাবেই একটি গণতান্ত্রিক দেশের রাজনৈতিক চরিত্র হতে পারে না। ক্ষমতার পালাবদল গণতান্ত্রিক পন্থায় ভোটের মাধ্যমে আসুক। ষড়যন্ত্র, কালো টাকার পেশিশক্তির যে কোনো পন্থার ব্যবহার জনগণ কামনা করে না। বাংলাদেশের জনগণ ভাত, মাছ, তরিতরকারি খেতে অভ্যস্ত। ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ইচ্ছেমতো প্রার্থীকে রায় প্রদানে খুশি। নিজের পছন্দের নেতা নির্বাচনকে তাদের অন্যতম খুশির কাজ। বিপরীতভাবে অন্য পথে অগণান্ত্রিক যে কোনোভাবে ক্ষমতা গ্রহণ এ দেশের জনগণ মোটেও সহ্য করে না। বরং কঠোরভাবে এসব কার্যক্রমকে ঘৃণা করে এবং প্রত্যাখ্যান করে। এটি বাংলাদেশের জনগণের একটি মৌলিক চরিত্র বলা যায়।

দেশের সার্বিক উন্নয়নের সঙ্গে গণতন্ত্রের চর্চার উন্নয়ন দেখতে চাই। আমাদের দেশ এবং সরকার দেশের জনগণের মতামতে চলবে। বাংলাদেশ এবং এ দেশের জনগণ সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক এবং পারস্পরিক বন্ধুত্বের মাধ্যমে চলবে। জনগণের প্রত্যাশা সব দলের অংশগ্রহণ ও সহাবস্থানের মাধ্যমে দেশের নির্বাচনী কার্যক্রম ও রাজনীতি পরিচালিত হোক।

আমাদের কথা হলো, রাজনীতি হোক কল্যাণমুখী , রাজনীতি হোক জনগণের জন্য । যে রাজনীতি শিখিয়েছে বিশ্বনন্দিত নেতা নেলসন মেন্ডেলা । তার নেতৃত্ব এবং ক্ষমা প্রদর্শনের দর্শন সারা বিশ্বের মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। ম্যান্ডেলার এই শান্তি ও সাম্যের নীতিগুলি এখনও বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত ও চর্চিত।

সমাধানের রাজনীতি বলতে আমরা এমন একটি রাজনৈতিক নীতি বা কৌশল বুঝিয়েছি যেখানে সমস্যা সমাধানকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এটি এমন একটি পদ্ধতি যেখানে রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা সরকার সাধারণ মানুষের সমস্যার সমাধান ও তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে কাজ করে, দলীয় স্বার্থ বা ক্ষমতার লড়াইয়ের চেয়ে সমাজের উন্নয়নকে গুরুত্ব দেয়।

এই ধরনের রাজনীতি গণতান্ত্রিক আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার মূল কারণ চিহ্নিত করে, সংশ্লিষ্ট পক্ষের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করে এবং টেকসই সমাধান প্রদান করে। “সমাধানের রাজনীতি” শুধু ক্ষমতা অর্জনের মাধ্যম নয় বরং দীর্ঘমেয়াদী স্থায়িত্ব, সমাজের শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয়।

লেখক: শিক্ষার্থী , জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

You might also like
Leave A Reply

Your email address will not be published.